খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাদের উন্নতির পেছনে অন্যতম কারণ বিদেশি বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ একে অন্যের পরিপূরক। ক্রমাগত উন্নয়নের পথে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ রয়েছে। এই দেশে বিনিয়োগে মুনাফার পরিমাণ অনেক বেশি। একইসঙ্গে ঝুঁকি প্রায় শূন্যের কোঠায়।
বাংলাদেশের ভূগর্ভে রয়েছে তেল ও গ্যাসের মজুদ। প্রকাশিত তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে ৩০.১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ আছে, যার মধ্যে ইতোমধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে ১৯.৫৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়া সাগর ও দেশের স্থলভাগে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ভোলার শাহবাজপুর, পাবনার মোবারকপুর, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা, সিলেটের ছাতকের পূর্ব অংশে বড় গ্যাস কাঠামোর সন্ধান মিলতে পারে।
এদিকে সাগরে ভারত ও মিয়ানমার অংশে যেহেতু তেল-গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশ অংশেও তেল-গ্যাস পাওয়া যাবে, এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। মিয়ানমার এরই মধ্যে গ্যাস রপ্তানি শুরু করেছে। আর আমরা রয়েছি শঙ্কায় কারণ বর্তমানে যে গ্যাস মজুদ রয়েছে, সেটা বর্তমান ব্যবহার হারে আগামী ৯ -১০ বছর চলবে। এজন্যই বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এ খাত আজ বিপুল সম্ভাবনাময়। বিদেশি বিনিয়োগের সাথে সাথে সেখান থেকে প্রযুক্তিগত সুবিধাও আমরা পাবো, গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান বাড়ানো সম্ভব হবে।
বিশ্বে পর্যটন এখন সবচেয়ে লাভজনক এবং গতিশীল খাত। পর্যটন এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যেখানে প্রচুর বিনিয়োগ না করেই বিপুল আয় করা সম্ভব। পর্যটনের জন্য তেমন কিছু সৃষ্টি করতে হয় না। শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত উপকরণকে রূপান্তরের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করলেই চলে। পর্যটন স্পটগুলোকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে এ খাত থেকে বিপুল আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের উন্নতির জন্য দর্শনীয় বস্তুর অভাব নেই। এদেশে বিরাজমান প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি যুগে যুগে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন দেশে পর্যটন খাতে গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো, উন্নত করা হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় বহু পর্যটক ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করে। এমনকি বাংলাদেশে না এসে চলে যায় ভুটান কিংবা নেপালে।
বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের একটি বৃহৎ অংশ আসে পোশাক খাত থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে এ দেশের তৈরি পোশাকের বিপুল চাহিদা রয়েছে। কোটামুক্ত বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ স্থাপন। সে কারণেই আমাদের দেশে পোশাক খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের জয়েন্ট ভেঞ্চারের প্রচুর সুযোগ রয়েছে।
কৃষি দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৫৫ ভাগ কোনো না কোনোভাবে কৃষিতে নিয়োজিত। কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় উপখাত হলো শস্য খাত, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৬৯.৫৬ ভাগ জোগান দেয়। মৎস্য, প্রাণিসম্পদ এবং বন উপখাতের অংশ যথাক্রমে শতকরা ১০.৩৩, ১০.১১ এবং ১০.০০ ভাগ। বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এক বিপুল সম্ভাবনাময় খাত। তাছাড়া উন্নত ফলনশীল বীজ উৎপাদন, সবজি প্রক্রিয়াকরণ, ফল সংরক্ষণসহ বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশের কৃষিজাত পণ্যের প্রবেশের বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।
বিদেশে যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেখানে ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারী উদ্যোগ সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। অদক্ষ কোনো ব্যক্তির প্রবাসে যাওয়ার দরকার নেই। কারিগরি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর বিদেশে যেতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে।
জাতীয় শিল্পনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে সবুজ/উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন, উদ্ভাবনীমূলক এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ শিল্পে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগে উৎসাহ বৃদ্ধিসহ আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। বিদেশি শিল্প বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্তে ‘ইন্টিগরেটেড ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অঞ্চল/দেশভিত্তিক শিল্প পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট দেশের ভ্যালু চেইনের সাথে যুক্ত হবার সুযোগ থাকবে।
বিদেশি বিনিয়োগকারী ১০(দশ) লক্ষ ইউএস ডলার বিনিয়োগ করলে বা ২০(বিশ) লক্ষ ইউএস ডলার কোন স্বীকৃত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করলে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন। এছাড়া, সম্ভাবনাময় বিদেশি বিনিয়োগকারীকে ন্যূনতম ৫(পাঁচ) বছরের জন্য মাল্টিপল ভিসা প্রদান করা হবে। বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তাগণও কর অবকাশ, রয়্যালটি প্রদান, প্রযুক্তি কল্যাণ ফি ইত্যাদির সুবিধা পাবেন। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারী কোম্পানি কিংবা যৌথ বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের সুপারিশের ভিত্তি করে বিদেশি দক্ষ পেশাজীবীদের ‘ওয়ার্ক পারমিট’ প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।
বাংলাদেশে কোন ভারী শিল্পে কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে কোন শিল্পে/ব্যবসায়ে কমপক্ষে ১০(দশ) মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছেন এরূপ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অব্যাহত অাছে মর্মে বোর্ড/বেজা কর্তৃক প্রত্যয়ন সাপেক্ষে বিদেশি বিনিয়োগকারী বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদেয় ‘নো ভিসা রিকুয়্যার্ড’ সুবিধা অব্যাহত থাকবে। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পখাতসমূহে বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ করে হস্ত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগকারীকে বিসিক শিল্প নগরীতে/অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে। সৌর শক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, বায়ুকল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, বায়োমাস, গৃহস্থালি বর্জ্য ও শিল্প বর্জ্য ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ইত্যাদিসহ সকল প্রকার নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর সাথে সাথে আমাদের দেশের জন্য রেমিট্যান্সের গুরুত্বও অত্যন্ত বেশি। প্রবাসীরা যেন হুন্ডি ব্যবসায়ীদের প্রলোভনে না পড়ে, সেই কর্মসূচি আরো বেশি গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রবাসীদের প্রেরিত পাঠানো রেমিট্যান্সের উপর উপর ক্যাশ প্রণোদনা দিচ্ছে, ব্যাংকগুলোও প্রতিযোগিতার কারণে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রণোদনা দিচ্ছে। একইসাথে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণের জন্য প্রবাসীদের সকল প্রকার ভোগান্তি দূর করতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণের জন্য আরো সহজ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের প্রবাসী কর্মীরা অনেকেই লেখাপড়া জানে না। যদি অর্থ প্রেরণের জন্য ব্যাংকিং প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ না হয়, তবে অনেকেই ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। রেমিট্যান্স সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনে নিয়োজিত সকল অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত সার্কুলারের সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
বিদেশে যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেখানে ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারী উদ্যোগ সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। অদক্ষ কোনো ব্যক্তির প্রবাসে যাওয়ার দরকার নেই। কারিগরি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর বিদেশে যেতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। বিদেশে যে বিষয়ের উপর দক্ষ কর্মী চাওয়া হয়, আমাদের তা থাকে না। অথচ আমরা যদি সঠিকভাবে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারতাম, তবে বেকারত্বের হারও কমে যেত।
এতে করে আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং রেমিট্যান্সের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। আর দালালের খপ্পরে পড়ে কেউ যেন অবৈধ ভাবে বিদেশে পাড়ি না জমায়, বিষয়টি কঠোরভাবে বন্ধ করা উচিত। প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা যেন দেশে বিনিয়োগ করতে পারে, সেই জন্য সহজ ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবাসী ব্যবসায়ীরা দেশে বিনিয়োগ করলে, রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রবাসী-আয় নেতিবাচক হলে জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাহত হবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যা আমাদের কারোই কাম্য নয়।
লেখক : যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
এইচআর/জেআইএম