বিদেশি ব্র্যান্ডের দখলে মেরিন পেইন্টের বাজার

1 hour ago 2

বাংলাদেশের অনেক খাত এখনো আমদানিনির্ভর। আবার রপ্তানির বাজারেও বড় অংশীদার বাংলাদেশ। আমদানি-রপ্তানির বড় অংশ পরিচালিত হয় সমুদ্রপথে। গভীর সমুদ্রে চলাচল করা জাহাজে বিশেষ ধরনের রং ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টিফাউলিং এই মেরিন পেইন্টের বাজার প্রায় বিদেশি ব্র্যান্ডের দখলে।

সমুদ্র ও নৌযানের নিরাপত্তা, দীর্ঘ স্থায়ীত্বের ক্ষেত্রে পেইন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদা থাকলেও জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতে বিদেশি পেইন্টের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। আমদানির পাশাপাশি লোকাল এজেন্ট থেকেও বিদেশি পেইন্ট সংগ্রহ করা হয়। আবার অবৈধপথে আসা মেরিন পেইন্টের কারণেও বাজার হারাচ্ছেন দেশি উদ্যোক্তারা। তাদের অভিযোগ, সরকারি অত্যধিক শুল্ক-করের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশি পেইন্ট শিল্প।

নৌ ও সমুদ্রপথে চলাচলকারী যানগুলো কাঠ-লোহা দিয়ে তৈরি হয়। যে কারণে পানিতে লবণাক্ততা ও আর্দ্রতার কারণে মরিচা ধরে এসব যান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ঝুঁকি তৈরি হয় চলাচলে। লবণাক্ত গভীর সমুদ্রে চলাচল করা জাহাজ ও নৌপথে চলাচল করা নৌযানে ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের রং। এই রং মেরিন পেইন্ট হিসেবে পরিচিত। লবণাক্ত পানি, আর্দ্রতা, শৈবাল, ফাংগাস, জং থেকে নৌ ও সমুদ্রযানকে সুরক্ষা দিতে ব্যবহার করা হয় এ পেইন্ট। গভীর সমুদ্রে চলাচল করা জাহাজের জন্য প্রয়োজন হয় অ্যান্টিফাউলিং পেইন্ট।

জাহাজে যে রং ব্যবহার হয়

ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাহাজে বিভিন্ন ধরনের মেরিন পেইন্ট ব্যবহার করা হয়। জাহাজের হালে বা নিচের অংশে শৈবাল, শামুক, বার্নাকলরোধে ব্যবহার করা হয় অ্যান্টিফাউলিং পেইন্ট। এসব পেইন্টে কপারঅক্সাইড যুক্ত থাকায় পানির নিচে সুরক্ষিত থাকে।

বায়াররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জতুন, হ্যাম্পেল ব্র্যান্ডের পেইন্ট নিয়ে আসেন। এগুলো ইন্টারন্যাশনাল পেইন্ট (আইপি) হলেও এখানে লোকাল এজেন্ট আছে। জতুন ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কারখানাও করেছে। পেইন্টের মধ্যে প্রয়োজনে আমরা বার্জারও নিই।-ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল কাদের

জাহাজের নিচের অংশের লোহার পাতকে পানি ও জং থেকে রক্ষা করতে ব্যবহার করা হয় ইপক্সি কোটিং (এক ধরনের পেইন্ট)। জাহাজের বাইরের অংশ, ডেক, জাহাজের ডেক, কেবিন, ইঞ্জিন রুমের সৌন্দর্যের জন্য পলিউরেথেন পেইন্ট লাগানো হয়। জাহাজের ভেতরের তলায় প্রাইমার (জিঙ্ক রাইস পেইন্ট) ব্যবহার করা হয়। আর ফিশিং ট্রলার কিংবা বোটের তলার পাটাতনে ব্যবহার করা হয় বিটুমিনাস পেইন্ট।

আরও পড়ুন
কাঁচামাল সস্তা হলেও কমছে না প্রাণিখাদ্যের দাম
বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া এফটিএ হলে খুলবে আসিয়ানে রপ্তানির দুয়ার
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলবে বাড়তি বন্দর মাশুল
বন্দর মাশুল বাড়ায় দাম বাড়বে খাদ্যপণ্যের

জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্পে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে যেসব জাহাজ নির্মাণ হয়, সেসব জাহাজের নির্মাণ উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। পাশাপাশি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কিছু ক্ষেত্রে কিছু উপকরণ দেশি উৎস থেকে নিয়ে ব্যবহার করেন। দেশে তৈরি নৌযানের ক্ষেত্রে স্টিলের পাটাতন, যন্ত্র, মোটরসহ অনেক উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আছে অতিগুরুত্বপূর্ণ উপাদান রংও। অনেক ক্ষেত্রে দেশি এজেন্ট থেকে বিদেশি রং সংগ্রহ করে ব্যবহার করা হয়। তবে চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা (শিপ ব্রেকিং) ইয়ার্ড থেকেও মেরিন পেইন্ট জাহাজ মেরামতে ব্যবহার করা হয়।

ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে এগোচ্ছে দেশি শিল্প, পিছিয়ে রঙে

চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, ‘বায়ার এলসি (ঋণপত্র) করে যাবতীয় উপকরণ নিয়ে আসেন। সম্প্রতি আমরা জাহাজ নির্মাণে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের মাধ্যমে দেশি সোর্স থেকে কিছু ম্যাটেরিয়াল নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমানে ওয়েল্ডিং রড, ফার্নিচার, স্যানিটারি আইটেম, টাইলস প্রায় পুরোপুরি দেশি উৎস থেকে নেওয়া হয়।’

মেরিন পেইন্টে এখনো আমাদের দেশীয় পেইন্টগুলো ইন্টারন্যাশনাল পেইন্টের উপযোগী হতে পারছে না। যে কারণে জাহাজ তৈরি ও মেরামতে বিদেশি পেইন্টের ব্যবহার বেশি হচ্ছে।- শাহ আমানত ডকইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন বকুল

তিনি বলেন, ‘বায়ার এলসি করে যেসব ম্যাটেরিয়ালস আনেন তার বাইরের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু লোকাল সোর্স থেকে নেওয়া হয়। এর মধ্যে রং অন্যতম। বায়াররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জতুন, হ্যাম্পেল ব্র্যান্ডের পেইন্ট নিয়ে আসেন। এগুলো ইন্টারন্যাশনাল পেইন্ট (আইপি) হলেও এখানে লোকাল এজেন্ট আছে। যে কারণে সহজলভ্য। জতুন ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কারখানাও করেছে। পেইন্টের মধ্যে প্রয়োজনে আমরা বার্জারও নিই। বার্জারের প্রোডাক্টগুলোও কোয়ালিটিফুল।’

কর্ণফুলী শিকলবাহা এলাকার শাহ আমানত ডকইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন বকুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ড্রেজার ও লাইটার জাহাজ মেনটেন্যান্স (মেরামত) করি। যাদের জাহাজ তারাই রং সরবরাহ করেন। আমাদের কারিগররা পেইন্টের কাজ করেন। আমাদের ইয়ার্ডে মূলত বার্জার ব্যবহার করি। অনেক সময় জতুনও ব্যবহার করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘মেরিন পেইন্টে এখনো আমাদের দেশীয় পেইন্টগুলো ইন্টারন্যাশনাল পেইন্টের উপযোগী হতে পারছে না। যে কারণে জাহাজ তৈরি ও মেরামতে বিদেশি পেইন্টের ব্যবহার বেশি হচ্ছে।’

সমুদ্রগামী জাহাজে সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এফএমএস মেরিন সার্ভিসের সিইও ইঞ্জিনিয়ার এস এম সানোয়ারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যখন জাহাজে পেইন্ট সাপ্লাই দিই, তখন বেশিরভাগ মালয়েশিয়ান জতুন সরবরাহ করি। এটি ইন্টারন্যাশনাল পেইন্ট, সহজলভ্যও। জতুনের এখানে এজেন্ট রয়েছে। অনেক সময় ক্লায়েন্টরাই জতুন দেওয়ার জন্য অর্ডার করেন। তাছাড়া ইন্টারন্যাশনাল পেইন্টের মধ্যে হ্যাম্পেলও ব্যবহার করা হয়। আবার কোথাও অল্প লাগলে বার্জার ব্যবহার করি।’

মেরিন পেইন্ট ও উপকরণের প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আবার বিদেশি পেইন্টের স্থানীয়ভাবে এজেন্ট রয়েছে। তারা অপেক্ষাকৃত কম শুল্কে বাংলাদেশে প্রোডাক্ট এনে বিক্রি করছে। কিন্তু দেশি উৎপাদনকারীদের বেশি শুল্ক দিয়ে আমদানি করে স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে।- বিপিএমএর জেনারেল সেক্রেটারি অরুণ মিত্র

তিনি বলেন, ‘আমাদের জাহাজের স্ক্র্যাপইয়ার্ডে বিদেশি অনেক রং পাওয়া যায়। সেখান থেকেই আমরা বেশিরভাগ রং সংগ্রহ করি। আমাদের বেশি রং লাগে না। যাদের ডকইয়ার্ড, শিপইয়ার্ড রয়েছে, তাদের বেশি পরিমাণে রঙের প্রয়োজন হয়।’

মোট চাহিদার ৩ শতাংশ মেরিন পেইন্ট

পেইন্ট শিল্পে জড়িতরা বলছেন, বাংলাদেশে ব্যবহৃত পেইন্টের ৮০ শতাংশ ডেকোরেটিভ। মোট চাহিদার মাত্র তিন শতাংশ মেরিন পেইন্টের। এর মধ্যে দেশি পেইন্ট মার্কেট থেকে দুই শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। দেশে বার্জার, রেইনবো, ইম্পেরিয়াল, রক্সিসহ আরও দু-একটি কোম্পানি মেরিন পেইন্ট উৎপাদনে আছে। বাংলাদেশ পেইন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে ২৩০ হাজার মেট্রিক টন রং ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে মেরিন পেইন্ট রয়েছে সাড়ে চার হাজার টনের কিছু বেশি, যা মোট ব্যবহারের দুই শতাংশ।

সূত্র জানায়, মেরিন পেইন্টের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল পেইন্ট (আইপি) হিসেবে নরওয়ের ব্র্যান্ড জতুন, ড্যানিস ব্র্যান্ড হ্যাম্পেল, জাপানি ব্র্যান্ড নিপ্পন পেইন্ট ব্যবহার করা হয়। এরা মূল উৎপাদক। এসব কোম্পানির বিভিন্ন দেশে কারখানা রয়েছে। দেশের জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতে আগে থেকে মালয়েশিয়ান জতুন, আমিরাতের হ্যাম্পেল পেইন্ট বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। সম্প্রতি জতুন বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করেছে। অন্যদিকে, বার্জারের জাপানি চুগুকু মেরিন পেইন্টস (সিএমপি) প্রযুক্তির অ্যান্টিফাউলিং কোটিং জাহাজ মেরামতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর মেরিন পেইন্ট

বিপিএমএর জেনারেল সেক্রেটারি অরুণ মিত্র জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের উন্নয়নে রং শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সরকারিভাবে এ শিল্পকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। বিশেষ করে রং একটি অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ হলেও সরকার এটি বিলাসবহুল পণ্য ঘোষণা দিয়েছে। এতে দেশি উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত রং ও প্রাইমারের ওপর ১০ শতাংশ এসডি (সম্পূরক শুল্ক) এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। অথচ জনগণের মূল্যবান সম্পদের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের জন্য, পরিবেশ রক্ষা ও ঝুঁকি থেকে সম্পদ রক্ষায় রং ব্যবহার করা হয়। এটি দেশের জাতীয় বাজেটের অপচয়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হ্রাস করছে।’

তিনি বলেন, ‘মেরিন পেইন্ট ও উপকরণের প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আবার বিদেশি পেইন্টের স্থানীয়ভাবে এজেন্ট রয়েছে। তারা অপেক্ষাকৃত কম শুল্কে বাংলাদেশে প্রোডাক্ট এনে বিক্রি করছে। কিন্তু দেশি উৎপাদনকারীদের বেশি শুল্ক দিয়ে আমদানি করে স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ এ শিল্পে দক্ষতা ও উন্নত প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও দেশি উদ্যোক্তাদের অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে। তারা ব্যবসা করতে পারছেন না।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম

Read Entire Article