বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য করণীয়

2 hours ago 3

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সুখবর এই যে, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের বৃদ্ধি ঘটেছে। ্কেউ বলে ‘উলম্ফন’। এক থেকে দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশীরা সেপ্টেম্বর মাসে পাঠিয়েছেন ২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। বলা হচ্ছে দেশের ইতিহাসে কোনো একক মাসে এটি তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়। সাধারণত যা হয়, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতো উৎসব সামনে রেখে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ উপচে পড়ে কিন্তু এবারই ব্যতিক্রম - বড় কোনো উৎসব ছাড়া এত বেশি পরিমাণ অর্থ দেশে ঢুকেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনাভাইরাস-সৃষ্ট দুর্যোগের সময় প্রবাসীরা রেকর্ড ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছেন , প্রবাসীরা দেশের গণ-অভ্যুত্থানকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বলেই দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের উৎসবে শামিল হচ্ছেন। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের এযাবতকালের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের অন্যতম জ্বালানি রেমিট্যান্স । কিন্তু যারা অর্থনীতির চাকায় জ্বালানি যোগায়, আমরা কতটুকু তাদের প্রাপ্য সন্মান দেখাই?

দুই.
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি প্রফেসরিয়াল ফেলো এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড. এম. নিয়াজ আসাদুল্লাহ সম্প্রতি বিষয়টির উপর আলোকপাত করেছেন। প্রথমত, তিনি মনে করেন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে, বিশেষত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে, আগমন এবং নির্গমন– উভয় ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রকম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চাদরে ঢাকা কার্যক্রম বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ব্যাপক ভোগান্তির কারণ। শ্রমিকদের এয়ারপোর্টে প্রবেশ, ইমিগ্রেশন, লাগেজ নিরাপত্তা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই হয়রানিতে নাস্তানাবুদ হতে হয়। সম্ভবত অশিক্ষিত এবং শ্রমিক শ্রেণির বলে এয়ারপোর্ট কর্মকর্তাদের অশোভন, অমানবিক আচরণ, কিছু না কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়মিত ঘটছে । ইদানিং এসব ‘অনাচার’ বন্ধে পদক্ষেপ প্রতিশ্রুত তবে সত্যিকার অর্থে আচরণে টেকসই পরিবর্তন আনতে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দৃষ্টি দিয়ে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করছেন তিনি । “ কেবল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা নয়, জাতীয়ভাবেও প্রয়োজন মানসিকতায় পরিবর্তন। পোশাকশিল্প আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত বিবেচনায় সেখানে শ্রমবান্ধব কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত, আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স ও মান উন্নয়ন করতে সরকারি প্রচেষ্টার কমতি নেই। সে তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় উৎস সত্ত্বেও কিন্তু প্রবাসীকল্যাণ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রলাণয় দুটি বিভিন্নভাবে যেমন বিতর্কিত, ঠিক তেমনই এদের ব্যস্থাপনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবাসগামী শ্রমিকদের জন্য কোনো আস্থার জায়গা নয়। এদের প্রশ্রয়েই দশকের পর দশক চলছে দালালদের দৌরাত্ম্য, যার সঙ্গে আরও যুক্ত প্রবাসগামী শ্রমিকদের নিয়ে বিমান সিন্ডিকেটের টিকিট বাণিজ্য। সেই অর্থে বিমানবন্দরের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি জাতীয় পর্যায়ে প্রবাসী শ্রমিক বিষয়ে সরকারি নীতি ও সেবা প্রদানে কাঠামোগত দুর্বলতা ও সমন্বয়ের ঘাটতির এক রকম প্রতিফলন। এ সবকিছুর বিবেচনাতেই হয়তো বর্তমান সরকার প্রবাসীদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়ার কথা বলছে “।

দ্বিতীয়ত, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করার জন্য তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক এবং সে তিনটি বিষয় অনেকটা হুবহু এরকম । এক. তাদের দেশে রেখে যাওয়া সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর মধ্যে এনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। দুই. তাদের বিনিয়োগকৃত ব্যবসায় উদ্যোগে কর মওকুফ করা এবং এ সব উদ্যোগ সফল করতে বাড়তি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। তিন. প্রবাসে চাকরি ও মজুরি-সংক্রান্ত প্রতারণা ও নির্যাতন মোকাবিলায় আইনি সহযোগিতা । একই সাথে প্রবাসীদের সঠিক নিবন্ধন ও তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি স্বচ্ছ ও সর্বজনীন ডেটাবেজ অত্যন্ত জরুরি। প্রত্যাবর্তিত প্রবাসীদের দেশের উন্নয়নে কীভাবে কাজে লাগানো যায় সে সংক্রান্ত পরিকল্পনার কথাও চিন্তায় রেখে ডাটা বেজ থেকে সাহায্য নেয়া যেতে পারে । “এটির ভিত্তিতে ইস্যু হতে পারে স্মার্টকার্ড, যেখানে সব ধরনের শনাক্তকরণ তথ্য থাকবে। প্রবাসে কর্মরত সময়ে নির্যাতনকারী মালিকপক্ষ কিংবা দালালরা শ্রমিকদের পাসপোর্ট নিয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে নিবন্ধিত শ্রমিকদের জন্য স্মার্টকার্ড কিছুটা আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে”।

চতুর্থত , গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে প্রশিক্ষণ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্রমিকদের আয় অন্য শ্রমিকদের চেয়ে বেশি । “শ্রমবাজার ধরে রাখতে কিংবা নতুন বাজারে প্রবেশ করতে গেলে দক্ষ জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই। লো ভ্যালু-অ্যাডেড থেকে হাই ভ্যালু-অ্যাডেড রপ্তানি খাতে উত্তরণের এ রকম লক্ষ্য আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জন্যও সত্য। কিন্তু জনশক্তি খাতে নীতি, নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা– তিন ক্ষেত্রেই ঘাটতি। আগামী দিনগুলোতে এশিয়ার উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে কৃষি ও শিল্প; দুই খাতেই বিভিন্ন কর্মদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে। আসিয়ান অঞ্চলের শ্রমিকদের এ ধরনের দক্ষতা থাকায় ২০২২ সালে তারা অস্ট্রেলিয়ার কৃষি খাতে একটি আকর্ষণীয় স্কিমের জন্য বিবেচ্য হয়েছে। কানাডায় একই রকম সুযোগ আছে এবং আসবে “।

পঞ্চমত, এবং বলা বাহুল্য, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের শিক্ষার মান সর্বজনীনভাবে নিম্ন বিধায় কর্মবাজারে নতুন দক্ষতা অর্জন ও টেকসই করতে সম্পূরক সাক্ষরতার বিকল্প নেই । মোট কথা, শ্রমিক ও শিক্ষা অর্থনীতিতে প্রাজ্ঞ নিয়াজ আসাদুল্লাহ মনে করেন, সুনির্দিষ্ট ও বাজারমুখী কারিগরি প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার পাশাপাশি স্কুলশিক্ষা পর্যায়ে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে । এবং তা হলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কর্মবাজারে আমাদের শ্রমিকরা বাংলাদেশকে একটি দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত করতে পারে ।

সবশেষে, ষাটের দশক থেকে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে নাড়াচাড়া হলেও অদ্যাবধি এর উৎকর্ষ উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়। উপরন্তু কারগরি শিক্ষা নানা সমস্যায় জর্জরিত , এই শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদ অক্ষমতার পরিচয় দিয়ে কেবল সাধারণ উচ্চ শিক্ষার উপর ভর করেছেন। অথচ, সুভস্য সিঘ্রম হলে হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিসহ বিশ্বের অনেক সেবা এবং শিল্প খাতে আমাদের কারিগরি গ্র্যাজুয়েটরা অবদান রাখতে পারত। গবেষক মনে করেন কেবল মাত্র অপরিকল্পিত প্রসার এবং নিম্নমান– এ দুই কারণে বাংলাদেশ কারিগরি গ্র্যাজুয়েট রপ্তানির দেশ হিসেবেপরিচিত হতে পারিনি। দুঃখ করে তিনি বলছেন, জার্মানি “যেখানে উচ্চমানের কারিগরি শিক্ষিত কর্মী দিয়ে শিল্প খাতের ব্যাপক অর্জন টেকসই করেছে, আমাদের কারিগরি শিক্ষা না পারছে দেশের চাহিদা মেটাতে, না পারছে বিদেশে শ্রম রপ্তানি করতে। একইভাবে আমরা ব্যর্থ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে মাদ্রাসা শিক্ষিত, আরবি ভাষায় দক্ষ গ্র্যাজুয়েট রপ্তানি করতে“।

আমরা আশা করবো বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যায্য ব্যয়ে বিদেশ যাওয়া , বিমানবন্দরে প্রাধিকার ভিত্তিতে তাঁদের প্রতি আচরণ এবং যাবার আগে তাঁদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। রিজার্ভ যখন তলানিতে, তখন দু হাত পেতে ওঁদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রা ভিক্ষা চেয়েছিলাম; তাঁরা সায় দিয়ে এক মাসেই দুই দশমিক চার বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে যার অধিকাংশ আসে মধ্য প্রাচ্য এবং উপসাগরীয় দেশে থাকা শ্রমিক থেকে। আমরা যেন তাঁদের প্রতি আমাদের কর্তব্যে অবহেলা না করি।

ভারত কিংবা অন্যান্য দেশ থেকে যারা আমাদের পোশাক শিল্পে কাজ করছে, তারা ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। এক অর্থে এটা আমাদের ব্যবসায় প্রশাসন শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা। এত বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রিধারী ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট থাকা সত্ত্বেও কেন আমাদের পোশাকশিল্প খাত ভারতীয় ব্যবস্থাপকনির্ভর? এত বিজনেস স্কুলের ভূমিকা কি? আমাদের বিশ্বমানের পোশাক খাত আছে। অথচ কেন আমরা সর্বজনীন মানের প্রশাসনে দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ?

“ আমাদের একটা গ্লোবাল ট্যালেন্টপুল আছে। তাদের নিয়েও সরকারের করণীয় আছে। দেশে বিভিন্ন খাতে তাদের শিক্ষা ও দক্ষতা কাজে লাগানো যায়। মাইগ্রেন্ট এন্টারপ্রেনিউরশিপ বলে একটা কথা আছে। অর্থাৎ প্রবাসীদের দেশে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজে লাগানো। যেমন আপনি যাচ্ছেন কর্মী হিসেবে, বেরুচ্ছেন উদ্যোক্তা হয়ে। অর্থাৎ বিদেশি শ্রমবাজারে কর্মী হিসেবে ঢুকছেন, দেশে এসে হলেন উদ্যোক্তা। এমন সুযোগ পেলে শ্রমিকরাও উজ্জীবিত হতে পারেন “।

তিন.
কথা পরিষ্কার । আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বৃহৎ অংশীদার বিদেশে কর্মরত শ্রমিক । তাদের পাঠানো বছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভে যায়, মোট আমদানি ব্যয়ের ২৫-৩০ ভাগ মেটায় । এঁরা বেশিরভাগ আধা শিক্ষিত কিংবা মূর্খ, প্রশিক্ষণের অভাব নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়া খুব কম মজুরির বিনিময়ে। বিমান বন্দরে প্লেনে উঠা এবং নামার আগে যে ফর্মটা পূরণ করতে হয় তাও অন্যকে দিয়ে করাতে হয়। ঢাকায় ঢুকার পর বিমান নামার আগে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেশের মাটি, আকাশ , প্রকৃতি দেখার জন্য। তাঁদের এই হুমড়ি খাওয়া অবস্থা নিয়ে এক বিখ্যাত অধ্যাপক এক অনুষ্ঠানে একবার বেশ রসালো কৌতুক, অমানবিক অবশ্যই , করে হাসির রোল সৃষ্টি করেছিলেন। অথচ অধ্যাপক মহোদয় ভুলে গিয়েছিলেন যে , যে প্লেনে তিনি দেশে ফিরছিলেন ওই প্লেনটি এই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিতেন্সে কেনা। এঁরা দালালের খপ্পরে পড়ে অনেক ব্যয় করে বিদেশ যায় অথচ খরচ কমানোর কিংবা বিড়ম্বনা দূর করার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।

আমরা আশা করবো বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যায্য ব্যয়ে বিদেশ যাওয়া , বিমানবন্দরে প্রাধিকার ভিত্তিতে তাঁদের প্রতি আচরণ এবং যাবার আগে তাঁদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

রিজার্ভ যখন তলানিতে, তখন দু হাত পেতে ওঁদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রা ভিক্ষা চেয়েছিলাম; তাঁরা সায় দিয়ে এক মাসেই দুই দশমিক চার বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে যার অধিকাংশ আসে মধ্য প্রাচ্য এবং উপসাগরীয় দেশে থাকা শ্রমিক থেকে। আমরা যেন তাঁদের প্রতি আমাদের কর্তব্যে অবহেলা না করি।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article