আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনা করতে জাতীয় কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইনের অধীনে করা এসব চুক্তিতে সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো রক্ষিত হয়েছে কি না, কমিটিকে তা নিরীক্ষা করতে বলা হয়। পর্যালোচনা কমিটি আদানি, সামিট, বেক্সিমকো, ইন্ট্রাকোসহ ১১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য পর্যালোচনা করেছে।কমিটি সরকারকে আন্তর্জাতিক আইনি ও তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পরামর্শ দেয়। তবে সেই সুপারিশের ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও সরকার এখনো তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।সরকার ভাবছে আমরা তো বেশিদিন ক্ষমতায় থাকবো না। আর এ ভাবনা থেকেই জোরালো পদক্ষেপটা আসছে না। ফলে গতানুগতিকভাবেই সব চালানো হচ্ছে, যা হতাশাজনক।
ক’বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট বিরাজমান। এসব সংকটের পেছনে অন্যতম দায় রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের। এ দুই খাতে একের পর এক ভুল ও রাজনীতি প্রভাবিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া আর্থিক ও পরিচালন ব্যবস্থায় দুর্বলতাও পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষত বিগত সরকারের শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ঘটেছে। অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি এবং দেশীয় উৎসের চেয়ে আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো উদ্যোগে অলাভজনক খাতে পরিণত হয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এ খাতের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে দেউলিয়া হয়েছে বহু প্রতিষ্ঠান।
গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে লাখ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্টও দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রাথমিক জ্বালানি হলেও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি। গ্যাস খাতকেও আমদানিনির্ভর করা হয়েছে। এতে সরকারকে দুই খাতের জন্যই প্রতি বছর বিপুল অংকের টাকা ভর্তুকি গুনতে হয়। ২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা এবং ৬৮ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে গ্যাস ও জ্বালানির অন্যান্য খাতে। জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ না দেয়ার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে দিতে হয়েছে। অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ভুল নীতি-কৌশলের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সরকার ও অর্থনীতির জন্য বড় বোঝা হয়ে উঠেছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে উত্তরণের ফলে জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আর্থিক সাশ্রয়, জনস্বাস্থ্যের ওপর অনুকূল প্রভাব, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাস প্রভৃতি সুবিধা রয়েছে। নবায়নযোগ্য ক্ষেত্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো গেলে সেটিও জ্বালানি আমদানি বাবদ বিপুল অর্থ সাশ্রয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। জ্বালানিনিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন শিল্প উৎপাদন নিশ্চিত করতে হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে যত দ্রুত সম্ভব স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। অনিয়ম-দুর্নীতি কমিয়ে সঠিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে উভয় খাতের কাঠামোগত রূপান্তর নিশ্চিত করতে হবে।
প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আর্থিক ও পরিচালন কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কাজ করবে। কার্যকর ও টেকসই নীতি প্রণয়ন করে ব্যয়সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত তৈরির পথে হাঁটবে। কিন্তু এ সরকারের দায়িত্ব নেয়ার এক বছর পরও তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। বিগত সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতির বড় মাধ্যম ছিল বিশেষ আইন—বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন। অন্তর্বর্তী সরকার এ আইন বাতিল করেছে। কিন্তু এ আইনের আওতায় নেয়া চুক্তিগুলোর বিষয়ে এখনো পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না পারার অভিযোগ রয়েছে।
আবার বিদ্যুৎ খাতের বিপুল বকেয়া পরিশোধে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব নেয়ার এক বছরে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করেছে তারা। কিন্তু ভর্তুকি, ক্যাপাসিটি চার্জ, আমদানিনির্ভরতা, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী রূপরেখা তৈরি করতে পারেনি। এদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমাও ঘোষণা হয়ে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী নির্বাচিত সরকারের জন্যও বড় আর্থিক চাপের কারণ হতে পারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।
দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বর্তমানে সাড়ে ২৭ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। আর বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৬ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। উৎপাদনে কাজে না এলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য সরকারকে দিতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। গত এক যুগে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। অন্যদিকে এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। অথচ স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা আবশ্যক। গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগ ও দক্ষ জনবল নিয়োজন, বিদ্যুতে ভর্তুকি ও ক্যাপাসিটি চার্জ ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার মতো পদক্ষেপ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে লাভজনক করা সম্ভব নয়।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, বিদ্যুৎ খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সংস্কার করা গেলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বছরে ১২০ কোটি ডলার বা ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় করতে পারে। এ সাশ্রয় খাতটিতে সরকারের দেয়া ভর্তুকি হ্রাসেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আইইইএফএর মতে, ভর্তুকি কমাতে সরকারকে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ চাহিদার অর্ধেক জাতীয় গ্রিড থেকে মেটাতে হবে। নতুন করে তিন হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত করতে হবে। এর সঙ্গে বছরে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিতরণে অপচয় ৮ শতাংশের মধ্যে রেখে এ অর্থ বাঁচাতে পারে বিপিডিবি।
এছাড়া ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি জ্বালানি সংকট সমাধানের দিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য ক্ষেত্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো গেলে বর্তমানে জ্বালানি ও বিদ্যুতের যে সংকট তৈরি হয়েছে তা অনেকাংশে কমিয়ে আনা যাবে। জীবাশ্ম জ্বালানির বিভিন্ন উৎস—প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে নিঃশেষিত হয়ে যায়। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে সহজে নিঃশেষিত হয়ে যায় না।
জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে উত্তরণের ফলে জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আর্থিক সাশ্রয়, জনস্বাস্থ্যের ওপর অনুকূল প্রভাব, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাস প্রভৃতি সুবিধা রয়েছে। নবায়নযোগ্য ক্ষেত্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো গেলে সেটিও জ্বালানি আমদানি বাবদ বিপুল অর্থ সাশ্রয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। জ্বালানিনিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন শিল্প উৎপাদন নিশ্চিত করতে হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে যত দ্রুত সম্ভব স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। অনিয়ম-দুর্নীতি কমিয়ে সঠিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে উভয় খাতের কাঠামোগত রূপান্তর নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার কার্যক্রম ও আর্থিক চাপ কমাতে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ দরকার। বিভিন্ন সময়ে নানা কার্যক্রম গৃহীত হলেও সেসবের গতিতে এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে।
দেশের বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক ব্যয় ও আর্থিক চাপ কমাতে প্রয়োজন সরকারের জোরালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে বিদ্যুতের ক্রয়চুক্তি বাতিল, কেন্দ্রগুলোর কাঠামোগত সংস্কার, সরকারের দিক থেকে বিদ্যুৎ খাতে সুযোগ-সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেসবের তেমন কিছুই সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এএসএম