বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়: নেতৃত্বের অভাব না প্রভাব?

3 months ago 48

বিএনপির টানা বর্জন এবং আওয়ামী লীগ ও মিত্রদের অংশগ্রহণে একতরফা নির্বাচনে ঐতিহ্য হারাচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা, কেন্দ্রে ভোটার না আসাসহ তৈরি হচ্ছে নানান জটিলতা। এরই মধ্যে কম ভোট হারের রেকর্ডও গড়েছে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। তিন ধাপের কোনোটিতে পড়েনি ৪০ শতাংশ ভোট। পাশাপাশি প্রথম তিন ধাপে ৫৮ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

এবার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করতে দলীয় প্রতীক রাখা হয়নি। পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে প্রতীকের ‘বিরূপ’ প্রভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। প্রতীক তুলে দেওয়ার পরও এত সংখ্যক প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীর প্রভাব, প্রার্থীর নিজস্ব প্রভাব, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সংস্থার প্রতি অন্য প্রার্থীদের আস্থার সংকট এবং জয়ী প্রার্থীর জনপ্রিয়তাসহ নানা বিষয়।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা বলছেন, গত ১৬ বছর দেশের প্রায় সবকটি জেলা-উপজেলায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন গুটিকয়েক নেতা। তৈরি হয়নি নতুন নেতৃত্ব। প্রতিযোগিতায় পুরোনো নেতারা থাকলেও ছিটকে পড়েছেন বা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি এর প্রভাব পড়েছে উপজেলা নির্বাচনেও। ভালো প্রার্থী মিলছে না। যেসব নেতা আছেন, গুটিকয়েক নেতার প্রভাবে তারা প্রার্থী হওয়ারও সাহস করছেন না।

সম্প্রতি ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হয়েছেন মঞ্জুরুল আলম রাজীব। তার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. কামরুজ্জামান খান (জামান) জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থন ছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত রাজীবের ওপর। সাবেক এমপি ডা. এনামুর রহমান তার সমর্থক ছিলেন। ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামও তার সমর্থক। এছাড়া সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগে তার সমসাময়িক নেতৃত্ব আর নেই।’

‘সাবেক ছাত্রনেতার মধ্যে তিনি সবার প্রিয়ভাজন। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে যারা আছেন তারাও তাকে সমর্থন করেন। বিশেষ করে ঢাকা- ১৯ আসনে নৌকার প্রার্থীর পরাজয়ের পর অনেক নেতার ভোটব্যাংকের পুরোনো হিসাব পাল্টে গেছে। তাই অন্য কেউ ঝুঁকি নিতে সাহস করেনি। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ কবিরও সমর্থন দিয়েছেন রাজীবকে। এমনকি গত নির্বাচনে যারা সাবেক এমপি মুরাদ জংয়ের পক্ষে নির্বাচন করেছিলেন তারাও রাজীবের প্রচারণায় ছিলেন সরাসরি। সব হিসাব মিলিয়ে রাজীব একক প্রার্থী হন।’

কুমিল্লা সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। কারণ জানতে চাইলে সাবেক ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিকল্প যোগ্য নেতৃত্ব না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। গত ১৫ বছর ধরে তো নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। যে যেখানে বসছে, সেখানেই যোগ্য থাকছে। এসব কারণে প্রার্থীর সংকট ছিল। আমাদের কেউ যদি আগ্রহী হতো, এরপর কেউ তাকে বাধা দিলে বা চাপ প্রয়োগ করলে বলতে পারতাম বা অভিযোগ করতে পারতাম। কেউ তো আগ্রহ প্রকাশ করেনি। বরং টাকা দিয়েও কাউকে প্রার্থী করা যায়নি।’

দায় নেতৃত্বের অভাব-প্রভাব
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছে নেতৃত্বের প্রভাবে। মূলত এখন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনসহ অন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের ব্যাপক আস্থাহীনতা। তাই ভোটাররাও ভোট দিতে যায় না। বিরোধী দলও নির্বাচন বর্জন করে। এটা হলো আস্থাহীনতার প্রতিফলন। এখন বিরোধী দল আসেনি। আর সরকারি দলের বড় বড় নেতাও তাদের প্রভাব বিস্তার করে তার প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করে নিয়েছেন।’

‘তিন ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ৫৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এটা কী কারণে হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? নেতৃত্বের অভাবে নাকি প্রভাবে?’ এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা সরলীকরণ করা যাবে না, একভাবে দেখা যাবে না। আলাদা আলাদা কারণ আছে। কোথাও প্রভাব, কোথাও একক জনপ্রিয়তা, কোথাও ম্যানেজ করার দক্ষতা, কোথাও বিনিময় ইত্যাদি কারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিটি উপজেলায় আলাদা আলাদাভাবে স্ট্যাডি করলে কারণগুলো উদঘাটিত হতে পারে।’

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব নির্বাচন আয়োজন করা, যারা নির্বাচনে অংশ নেয় তাদের নিয়ে কাজ করা। যারা অংশ নেয়নি, কী কারণে নেয়নি, সেটা গবেষণার বিষয়।’

তিন ধাপে ৫৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ২৫ জন ও দ্বিতীয় ধাপে ২১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া তৃতীয় ধাপে এখন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে ১২ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে ছয়জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৯ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১০ জন বিনা ভোটে জয়ী হন। দ্বিতীয় ধাপে চেয়ারম্যান পদে সাতজন, সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাতজন এবং সংরক্ষিত নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তৃতীয় ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন চেয়ারম্যান পদে একজন, ভাইস চেয়ারম্যান চারজন ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাতজন।

এর মধ্যে প্রথম ধাপে বাগেরহাট সদর, মুন্সিগঞ্জ সদর, মাদারীপুরের শিবচর ও ফেনীর পরশুরাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নাটোরের সিংড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদেও বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন।

এছাড়া বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে চেয়ারম্যান পদে বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন, তবে এ উপজেলার ভোট স্থগিত করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান এবং চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ভাইস চেয়ারম্যান, কক্সবাজার সদরে ভাইস চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটির কাউখালীতে ভাইস চেয়ারম্যান পদেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় এসেছে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় নারী ভাইস চেয়ারম্যান, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় নারী ভাইস চেয়ারম্যান, পাবনার বেড়া উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।

দ্বিতীয় ধাপে জয়ী চেয়ারম্যানরা হলেন কুমিল্লা আদর্শ সদরে মো. আমিনুল ইসলাম, জামালপুরের ইসলামপুরে মো. আ. ছালাম, ফরিদপুরের নাগরকান্দায় মো. ওয়াহিদুজ্জামান, চট্টগ্রামের রাউজানে একেএম এহছানুল হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় আবুল কাশেম চিশতী, সাভারে মঞ্জুরুল আলম রাজীব ও মৌলভীবাজার সদরে মো. কামাল হোসেন।

ভাইস চেয়ারম্যান পদে রাজশাহীর বাগমারায় মো. শহীদুল ইসলাম, রাঙ্গামাটির রাজস্থালীর শ্রী হারাধন কর্মকার, কুমিল্লা আদর্শ সদরে আহাম্মেদ নিয়াজ, চট্টগ্রামের রাউজানে নুর মোহাম্মদ, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মো. রফিকুল ইসলাম, রূপগঞ্জে মো. মিজানুর রহমান ও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সুমন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

এছাড়া নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে রাঙ্গামাটির রাজস্থালীর গৌতমী খিয়াং, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় সাঈদা সুলতানা, কুমিল্লা আদর্শ সদরে হোসনে আরা বেগম, চট্টগ্রামের রাউজানে রুবিনা ইয়াছমিন রুজি, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় হোসনে আরা বেগম, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে শাহিদা মোশারফ ও রূপগঞ্জের ফেরদৌসী আক্তার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ১৩৯ উপজেলায় ভোট হয় গত ৮ মে। এতে ভোট পড়েছে ৩৬ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে ১৫৬ উপজেলায় ভোট হয়েছে ২১ মে। গড়ে ভোট পড়ে ৩৭.৫৭ শতাংশ।

তৃতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচন হয়েছে ২৯ মে। এতে ভোট পড়েছে ৩৬ শতাংশ।

এসইউজে/এএসএ/জেআইএম

Read Entire Article