বিপ্লব-সংহতির সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন বাস্তবতায় ঐক্যের বার্তা বিএনপির

2 hours ago 9

৭ নভেম্বর ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ বিএনপির কাছে সৈনিক ও জনতার ঐক্যের প্রতীক। ৫০ বছর পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি দিনটিকে দেখছে নতুন অর্থ, ঐক্য ও পুনর্গঠনের আহ্বান হিসেবে। নেতারা মনে করছেন, দিনটির স্মৃতি শুধু অতীত নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাজনীতিরও দিশারি।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ঘটে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে সেনা ও সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছিল। বিএনপির দাবি, ওই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই দিনই জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভিত্তি। যদিও আওয়ামী লীগ সব সময় একে ‘রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের দিন’ হিসেবে দেখেছে।

সিপাহি-জনতার বিপ্লব শুধু ক্ষমতার বিন্যাস পরিবর্তনের দিন ছিল না, এটি দেশের গণতান্ত্রিক আদর্শের সংরক্ষণ এবং সার্বভৌমত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সূচনা। জিয়াউর রহমান মুক্ত হন এবং দেশের রাজনীতিতে নতুন প্রাণ আসে। ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক মুহূর্তে সেনা ও সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়ে রাজপথে নেমে আসে। জনগণ ও সেনাবাহিনীর ঐক্য প্রমাণ করে যে, তখনকার রাজনৈতিক সংকটের সময়ে জনতার সংহতি দেশকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যায়।

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কর্মীদের মাঠে ফেরার গল্প
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি এবারের ৭ নভেম্বরকে দিচ্ছে বিশেষ গুরুত্ব। নয় দিনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে—আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল, জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জেলা পর্যায়ের র‌্যালি ও সাংগঠনিক পুনর্মিলনী।

আরও পড়ুন
বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপির ৯ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা
৭ নভেম্বরের বিপ্লবই অর্থনীতি-গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিল
৭ নভেম্বরের বিপ্লব ও ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান একসূত্রে গাঁথা

দলীয় নেতারা মনে করছেন, এই কর্মসূচি শুধু ঐতিহাসিক দিবস পালন নয়, বরং কর্মীদের মনোবল জাগিয়ে তোলা এবং মাঠে ফেরানোর একটি প্রস্তুতি। জেলার বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে যাতে রাজনৈতিক চেতনা ও সাংগঠনিক শক্তি একসঙ্গে প্রদর্শিত হয়।

বিপ্লব সংহতির বার্তায় বিএনপির আহ্বান
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৭ নভেম্বর মহান জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গণমাধ্যমে দেওয়া বাণীতে বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব শুধু রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা নয়, এটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এক অনন্য উদাহরণ।

তিনি বলেন, ওই দিনে স্বজাতির স্বাধীনতা রক্ষায় অকুতোভয় সৈনিক ও জনতার ঢলে রাজপথে এক অনন্য সংহতির স্ফুরণ ঘটে এবং স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান মুক্ত হন।

তারেক রহমান বাণীতে আরও উল্লেখ করেন, স্বাধীনতার চেতনাকে জীবিত রাখতে ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সব জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই চেতনায় এগিয়ে আসা দেশের জন্য সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহান জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস স্মরণ করে তার বাণীতে বলেন, ৭ নভেম্বর জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় দিন। সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব এবং জনগণ ও সেনাবাহিনীর সমর্থনে শহিদ জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছান। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই বহুদলীয় গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ফখরুল আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে এখনো নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়নি। তাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই।৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক চেতনা ধারণ করে জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে, যাতে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মানবিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে।

নেতাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, বিএনপি এই দিনটিকে কেবল স্মৃতিচারণের জন্য নয়, বরং দলীয় পুনর্গঠন, কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি এবং নির্বাচনি প্রস্তুতির হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করতে চায়।

সাংগঠনিক কর্মসূচি ও জেলা-পর্যায়ের আয়োজন
নয়াপল্টন কার্যালয়সহ সারাদেশে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, মাজারে ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু হবে। ৭ নভেম্বর বিকেলে নয়াপল্টনে র‌্যালি, জেলা পর্যায়ে অনুরূপ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। ১২ নভেম্বর মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা হবে।

ছাত্রদলের আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শ্রমিকদলের সভা, ওলামাদলের এতিম শিক্ষার্থীদের সহায়তা, কৃষকদলের কর্মসূচি ও জাসাসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। ৬–১৩ নভেম্বর চলবে ‘৭ নভেম্বরের দলিলচিত্র’ ভিডিও ও পোস্টার প্রদর্শনী।

জোট রাজনীতির নীরবতা
২০-দলীয় জোট ভাঙনের পর ‘সমমনা জোট’ ও ‘বারো দলীয় জোট’-এর একাংশ বিএনপির পাশে থাকলেও যৌথ কর্মসূচি এখনো ঘোষণা হয়নি। গুলশান ও নয়াপল্টন কার্যালয়ে বৈঠক চলছে—কে কোন কর্মসূচিতে যুক্ত হবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস—দুটো শব্দের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সত্তা নিহিত। এই প্রেক্ষাপটেই জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে আবির্ভূত হন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতিস্বত্তা প্রতিষ্ঠা করেন, যা মূলত ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। ৭ নভেম্বরের চেতনাও তাই বোঝায়।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে। জিয়াউর রহমান জনগণের মধ্যে আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হন। সেই চেতনা আজও প্রাসঙ্গিক।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন জাগো নিউজকে বলেন, ‘৭ নভেম্বর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিন। আওয়ামী লীগ এটিকে সৈনিক হত্যা হিসেবে দেখলেও তাদের গত ১৬ বছরের সহযোগী জাসদ-বাসদ এটিকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে। তাই আওয়ামী লীগের ব্যাখ্যা অপব্যাখ্যা।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি এখন পুনর্গঠন ও মনোবল পুনরুদ্ধারের পর্যায়ে আছে। বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে তারা দলীয় ঐক্য এবং মাঠে ফেরার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে যে ঐক্য ও সংহতির কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবে সীমিত। মনোনয়ন ঘোষণার পর সারাদেশে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, তা বিবেচনায় রাজনৈতিক গুরুত্ব আরও জটিল।’

মোহন মন্তব্য করেন, ‘দিবসনির্ভর আলোচনা মাত্র দুই শতাংশ হলেও, মূল বিষয় হলো নির্বাচনের প্রেক্ষাপট, কর্মীদের প্রস্তুতি ও কৌশল। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, ওই আলোচনা সভাগুলোতে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে নির্বাচনি প্রচারণা বেশি প্রাধান্য পাবে।’

কেএইচ/এএসএ/এমআইএইচএস

Read Entire Article