বিবেক: মানবতার অন্তর্নিহিত আলো

1 month ago 8

আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, যেখানে চারদিকে হিংসা, লোভ, দ্বন্দ্ব, পরশ্রীকাতরতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা ছড়িয়ে পড়েছে। এই জগতে মানুষ নিজেকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে, হারিয়ে ফেলছে নিজের ভেতরের সেই অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী গুণটিকে—বিবেক। অথচ এই বিবেকই মানুষের সেই আভ্যন্তরীণ আলো, যা তাকে মানুষ করে তোলে।

বিবেক কী?

বিবেক (Conscience) হলো মানুষের ভেতরের এক প্রকার নৈতিক বোধ বা আত্মসচেতনতা, যা সৎ-অসৎ, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে। এটি একটি অন্তর্দৃষ্টি, একটি নৈতিক কম্পাস, যা প্রতিনিয়ত আমাদের মন ও কর্মকে মূল্যায়ন করে।

প্রাচীন দর্শনে,

  • সক্রেটিস বিবেককে বলেছিলেন “অন্তরের ঈশ্বরীয় কণ্ঠ”।
  • হিন্দু দর্শনে, এটি “অন্তরাত্মা”—আত্মার গভীর সত্যবোধের প্রকাশ।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেক

খ্রিষ্টধর্মে:

বাইবেল বলে:

“The conscience bears witness…” (Romans 2:15)

অর্থাৎ ঈশ্বর আমাদের হৃদয়ে সঠিক ও ভুলের জ্ঞান দিয়েছেন।

সেন্ট টমাস একুইনাস বলেন:

“Conscience is the application of knowledge to activity.”

বিবেক মানে ঈশ্বরপ্রদত্ত জ্ঞানের ব্যবহারিক রূপ।

খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস মতে, বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করা মানেই পাপ।

ইসলামে:

ইসলামে বিবেকের নিকটতম ধারণা হলো তাকওয়া—আল্লাহভীতি, আত্মসংযম এবং ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা।

কুরআনে বলা হয়েছে:

“আর প্রাণের শপথ… তারপর তাকে সঠিক ও ভুলের (পাপ ও পরহেযগারির) জ্ঞান দিয়েছেন।”
(সূরা আশ-শামস, আয়াত ৭–৮)

হাদিস বলছে:

“সৎকর্ম হলো যা তোমার বিবেককে শান্ত রাখে, আর পাপকর্ম হলো যা তোমার মনে অস্বস্তি সৃষ্টি করে…”

(সহিহ মুসলিম)

ইসলাম অনুযায়ী, বিবেক হল ফিতরা—জন্মগত সত্য-মিথ্যার উপলব্ধি।

ধর্মের হৃদয়ে বিবেক

প্রত্যেক ধর্মেই বিবেককে ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই যেখানে ধর্মের নামে হিংসা, লোভ, দুর্নীতি চলে—সেখানে ধর্মের রূপ আছে, হৃদয় নেই।

“ধর্মের মুখ যদি বিবেক না হয়, তবে সে ধর্ম শাসন নয়, শোষণ।”

আমরা এখন পর্যন্ত বিবেক সম্পর্কে কী জানি?

মনস্তত্ত্বে:

  • বিবেক গঠিত হয় মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে।
  • এটি শিক্ষা, পারিবারিক মূল্যবোধ, সমাজ ও অভ্যাসের ফসল।
  • ফ্রয়েড এর ভাষায়, এটি হল Super-Ego।

সমাজবিজ্ঞানে:

  • বিবেক গঠিত হয় সংস্কৃতি, আইন ও ধর্মের প্রভাবে।
  • সমাজ বিবেকের কাঠামো গড়ে তোলে।

আধুনিক গবেষণায়:

  • শিশুর মধ্যেও থাকে প্রাথমিক বিবেক।
  • সহানুভূতি, অপরাধবোধ প্রমাণ করে যে বিবেক একটি বিকাশমান ক্ষমতা।

বিবেক ও আত্মার সম্পর্ক

বিবেক হল আত্মার কণ্ঠস্বর—আত্মা যেমন আলোর উৎস, বিবেক সেই আলোর দিশারী।

তুলনায়:

  • আত্মা = দীপশিখা
  • বিবেক = সেই দীপশিখার আলো

প্লেটো বলেছিলেন:

“আত্মা জ্ঞান পেতে চায়, আর বিবেক তা অর্জনের নির্দেশ দেয়।”

উপনিষদে বলা হয়:

“আত্মা সব জানে, কিন্তু বলার জন্য বিবেক প্রয়োজন।”

কীভাবে বিবেকের চর্চা করা সম্ভব?

করণীয়:

১. আত্মজিজ্ঞাসা ও পরিকল্পনা

প্রতিদিন নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন:

“আমি কি ন্যায় করেছি?”

২. ধ্যান ও নীরবতা

নিজের মধ্যে শুনুন—ভেতরের কণ্ঠই সত্যিকারের পথপ্রদর্শক।

৩. “না” বলার সাহস

লোভ, অসত্য, সুবিধাবাদিতা—এই সব থেকে নিজেকে রক্ষা করুন।

৪. সহানুভূতি চর্চা

অন্যের ব্যথা বুঝুন, সাহায্য করুন।

৫. নৈতিক শিক্ষা ও সাহিত্যপাঠ

গান্ধী, রুমি, রবীন্দ্রনাথ—যারা বিবেকের পথ দেখিয়েছেন, তাদের পড়ুন।

বাস্তব উদাহরণ

একজন চিকিৎসক যখন অনৈতিক অর্থ গ্রহণ না করে রোগীর প্রকৃত সেবাকে বেছে নেন, তখন বিবেক জয়ী হয়।

এক বৃদ্ধাশ্রমের কর্মী বলেন:

“প্রথমে কাজ করতাম দায়িত্বে, এখন করি বিবেকের ডাকে। শেষ জীবনগুলোতে ভালোবাসাই সব।”

সতর্কতা: বিবেক নিঃশব্দ হয়ে যেতে পারে

প্রথমবার অন্যায় করলে বিবেক কাঁদে, দ্বিতীয়বার চুপ করে যায়, তৃতীয়বার—নীরব।

যখন বিবেকের কণ্ঠ আর শোনা যায় না, তখন মানুষ নৈতিকভাবে অন্ধ হয়ে যায়—চলতে পারে, কিন্তু দিশাহীন।

আজকের বাস্তবতা ও বিবেকের প্রাসঙ্গিকতা

এখন:

  • মিথ্যা দিয়ে সফল হওয়া যায়,
  • সত্য বললে নিঃসঙ্গ হতে হয়,
  • আত্মার কথা বললে ঠাট্টা হয়।

এই সময়েই বিবেক জাগ্রত রাখাটাই সবচেয়ে বড় মানবিকতা।

কীভাবে বিবেকের শক্তিকে শতভাগ ব্যবহার করা যায়?

  • নিজেকে প্রশ্ন করুন: আমি যা করছি, সেটা কি ন্যায়সঙ্গত?
  • ভালো বই পড়ুন, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকুন
  • সহানুভূতিশীল হোন, ক্ষমা করতে শিখুন
  • লোভ, হিংসা, অহংকার থেকে মুক্ত থাকুন

করণীয় ও বর্জনীয়

করণীয়:

  • সত্য বলুন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন
  • আত্মসমালোচনা করুন
  • ন্যায়ের পক্ষে থাকুন, একা হলেও

বর্জনীয়:

  • “সবাই করে” বলে নিজের অন্যায় বৈধ করা
  • ছোট অন্যায়কে উপেক্ষা করা
  • নীরব থেকে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া

বিবেকই মানবতার শেষ আশ্রয়

“একজন বিবেকবান মানুষ সেই আলো, যা অন্ধকারে পথ দেখায়—সে একা হলেও সত্যের সঙ্গে থাকে।”

বিবেক চর্চা কেবল ধর্মীয় কর্তব্য নয়, এটি একটি নৈতিক সাধনা। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি কিংবা ধর্ম—সবখানে সত্যিকার পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন মানুষ তার বিবেকের কথা শুনবে।

রহমান মৃধা, প্রবাসী বাংলাদেশি
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]

এমআরএম/জেআইএম

Read Entire Article