নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের প্রাচীন ও জনপ্রিয় হস্তশিল্প ছিল তাবিজ তৈরি। ধর্মীয় বিশ্বাস, লোকজ ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিক আস্থার প্রতীক হিসেবে তাবিজ বহুকাল ধরে মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে। তবে সময়ের সঙ্গে আধুনিকতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এ শিল্পটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে তাবিজের কদর ছিল। তখন হাটবাজারের প্রায় প্রতিটি কোণায় একজন করে তাবিজ প্রস্তুতকারক পাওয়া যেত। তৎকালীন সময়ে ‘কবিরাজ’ পরিচয়ে খ্যাত পুরুষ হাকিম, পীর-মুর্শিদগণ তাবিজ লিখে তা বিতরণ করতেন। এ তাবিজে থাকতো কোরআনের আয়াত, আরবি দোয়া, অথবা বিশেষ সংখ্যার গণিত-চিহ্ন। রোগবালাই থেকে মুক্তি, সাংসারিক কল্যাণ বা আত্মরক্ষা সবই জড়িয়ে ছিল এ তাবিজে।
তাবিজ তখন শুধু একটি ধর্মীয় অনুষঙ্গ ছিল না বরং একটি মানসিক নির্ভরতার মাধ্যম ছিল। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করত, তাবিজে মনের শান্তি ও সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০ বছর আগে থেকে লোকজ ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিক আস্থার প্রতীক হিসেবে যে তাবিজ মানুষ ব্যবহার করত। সেটি প্রস্তুত করে তার চাহিদার সিংহভাগ জোগান দিত এ উপজেলার তাবিজ শিল্পীরা। সে সময় রূপগঞ্জের প্রায় ৫ শতাধিক তাবিজ তৈরির কারিগর ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা, ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে তাবিজের ব্যবহার কমেছে আশঙ্কাজনক হারে।
- আরও পড়ুন
- মানুষ হুজুরদের কাছ থেকে পানিপড়া-তাবিজ নেয়, ভোট দেয় না
- তাবিজ ব্যবহার করা কি জায়েজ?
- তাবিজ দিয়ে হাতিয়ে নেন অর্ধশতাধিক মানুষের টাকা-স্বর্ণালংকার
অন্যদিকে পুঁজি সংকট ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি সবমিলিয়ে এ শিল্পে সংকট নেমে আসে। এর ফলশ্রুতিতে অনেক তাবিজ তৈরির কারিগররা এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। তবে এ চরম পরিস্থিতিতেও রূপগঞ্জের চোরাব, টান মুশরি, ভিংরাব, দক্ষিণবাগসহ সদর ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় এখনো দুই শতাধিক পরিবার তাবিজ তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। কেউ এটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, কেউবা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রেখেছেন। শত বছরের পুরোনো এ পেশাকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছেন তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিটি পরিবারের পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও তাবিজ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এমনকি শিশু-কিশোররাও কাজে সহায়তা করছে। সাধারণত পরিবারের সব সদস্য সম্পৃক্ত হন তাবিজের কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়ায়। বছরজুড়ে রূপগঞ্জের ঘরে ঘরে দেখা মেলে তাবিজ আর মাদুলি বানানোর কর্মব্যস্ততা।
তাবিজ তৈরির কাজ অনেক পরিশ্রমসাধ্য। ধাতব তাবিজ বানাতে প্রথমে তামা, ব্রোঞ্জ, দস্তা, লোহা, পিতল ইত্যাদি কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়। এসব কাঁচামাল কিনতে হয় কেজি প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। এরপর সাইজ অনুযায়ী কেটে তা সাঁচে ফেলে ঢালাই করা হয়। আগুনে ঝালাই, পাইন দিয়ে সিলিং এবং অবশেষে বিভিন্ন রঙের মেডিসিন দিয়ে সেটি রঙিন করা হয়। সম্পূর্ণ প্রস্তুতির পর তা বাজারে পাঠানো হয়। একটি পরিবার মাসে প্রায় ছয় হাজার থেকে ৮ হাজার তাবিজ তৈরি করে থাকে।
তাবিজের রয়েছে বহু আঞ্চলিক নাম, সাম্বু, বাম্বু, পাই, বড় মাজলা, ছোট মাজলা, মস্তুল ইত্যাদি। এগুলো বিক্রি হয় শত বা হাজার হিসেবে। লোহার তাবিজের দাম কম হলেও পিতল, রূপা বা স্বর্ণের তাবিজের দাম তুলনামূলক বেশি। বর্তমানে এ শিল্পে চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে।
কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে তাবিজের ব্যবহার ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা, শিক্ষার প্রসার এবং ধর্মীয় ব্যাখ্যার কারণে অনেকে তাবিজকে ‘শিরক’ বলে মনে করছেন যা এর জনপ্রিয়তাকে আরও হ্রাস করেছে।
একসময় রূপগঞ্জের তাবিজ শিল্প দেশের গণ্ডি পেরিয়ে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, এমনকি ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যেও রপ্তানি হতো। কিন্তু এখন সে রপ্তানি প্রায় বন্ধ। আগের তুলনায় আয় কম, পরিশ্রম বেশি, আর পুঁজির অভাবে নতুন প্রজন্ম এ পেশায় আসতে অনাগ্রহী।
এ শিল্পের প্রবীণ ও নবীন কারিগরদের কণ্ঠে রয়েছে হতাশা, তবুও পৈত্রিক পেশাকে টিকিয়ে রাখার প্রত্যয়। এ শিল্পের ব্যাপক সাফল্য থাকলেও বর্তমানে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও পুঁজি সংকটে এ শিল্পের কারিগরদের দুঃখ-দুর্দশার যেনো শেষ নেই। শিল্পটি এখন অস্তিত্ব সংকটে। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সহজ শর্তে ঋণসহ কিছু সরকারি উদ্যোগ ও সুবিধা দিলে টিকিয়ে রাখা যেতে পারে এ ঐতিহ্যবাহী তাবিজ শিল্পকে।
তাবিজের কারিগর রামপ্রসাদ অধিকারী বলেন, ‘প্রতিটি তাবিজ তৈরি করতে প্রকারভেদে প্রতি পিচ খরচ পড়ে ৮০ পয়সা থেকে ১ টাকা। অথচ পাইকারদের পুঁজিতে ব্যবসা করায় তাদের কাছে ওই তাবিজটি বিক্রি করতে হচ্ছে ১টাকা ২০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৭০ পয়সায়। আর নিজস্ব পুঁজিতে ব্যবসা করলে একই তাবিজ বিক্রি করা যেতো দেড় টাকা থেকে ২টাকা পর্যন্ত।’
৮০ বছর বয়সী তাবিজ কারিগর প্রিয় বালা রানী বলেন, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এ তাবিজ বানাইত, এহন আমিও ওনাগো কাজটা ধইরা রাখছি।’
তাবিজ প্রস্তুতকারক দিলীপ মণ্ডল বলেন, ‘রূপগঞ্জের মানুষ প্রায় ২০০ বছর ধরে এ পেশায় যুক্ত। আগে চাহিদা ছিল। আয়ও ভালো হতো। এখন আয় কম, খরচ বেশি। সরকারি সহায়তা পেলে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে হয়তো এ পেশা ধরে রাখা সম্ভব হতো।’
তাবিজ কারিগর নুরুল হক বলেন, ‘আমাদের তৈরি তাবিজ জেলা ছেড়ে চট্টগ্রামসহ ঢাকা, খুলনা, বগুড়া, বরিশাল, বরগুনা, গাজীপুর, নরসিংদী,কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ভোলাসহ দেশ ছাড়িয়ে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যেও রপ্তানি হয়। কখনো কখনো আমরাও দেশের বিভিন্ন জেলার হাটগুলোতে গিয়ে তাবিজ বিক্রি করি।’
তাবিজ শিল্পী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি মাসে একেকটি পরিবার প্রায় ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার তাবিজ তৈরি করেন। পাইকারদের পুঁজিতে ব্যবসা করায় ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে খুব একটা পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না। এ আয় দিয়ে সংসার না চললেও বাপ দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।’
এ বিষয়ে হাফেজ, মাওলানা, মুফতি শিহাব উদ্দিন জানান, শরীয়তসম্মত দোয়াভিত্তিক তাবিজ বৈধ হলেও কুফরি জাদুবিদ্যার ভিত্তিতে তৈরি তাবিজ হারাম ও শিরকের শামিল।
সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন ভুঁইয়া বলেন, ‘রূপগঞ্জের তাবিজ শিল্পের বর্তমান দুরবস্থার পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। এখন সময় এসেছে এ শিল্পটিকে সংরক্ষণের বিষয়ে নতুন করে ভাববার।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুনেছি এখানে বেশ কিছু পরিবার তাবিজ তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দ্রুত কারিগরদের সঙ্গে কথা বলব। উপজেলার পক্ষ থেকে তাদের কিভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়। যেভাবে এ তাবিজ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা যায় সে বিষয়ে চেষ্টা করব।’
আরএইচ/জিকেএস