বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে

2 hours ago 5

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো গবেষণা ও উদ্ভাবন। বর্তমান সময়ে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু পাঠদান কেন্দ্র হিসেবে নয় বরং গবেষণা, উদ্ভাবন এবং জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাঠামো ও শিক্ষাক্রমে মৌলিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, যেখানে শিক্ষার্থীরা গবেষণায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সৃজনশীলতা এবং বিশ্লেষণী দক্ষতা বিকশিত করতে পারবে।

গবেষণা এবং উদ্ভাবন ছাড়া কোনো জাতি আধুনিক বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায়, যেখানে উন্নত প্রযুক্তি এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সেখানে বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি গবেষণায় যথাযথ উন্নতি না আনে, তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতার জন্য তারা প্রস্তুত হতে পারবে না।

শুধু তত্ত্বভিত্তিক শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে না এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখাও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

এখন প্রয়োজন এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে গবেষণা শুধু তাত্ত্বিক ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধানেও ভূমিকা রাখতে পারে। উদ্ভাবন এবং গবেষণার মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি, পণ্য ও সেবা সৃষ্টি করা সম্ভব, যা দেশের শিল্প, প্রযুক্তি ও অর্থনীতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজের মাধ্যমে বাস্তব সমস্যার সমাধানে উদ্বুদ্ধ করতে ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিয়া কো-অপারেশন বাড়ানো যেতে পারে।

তবে, গবেষণা এবং উদ্ভাবনের জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো ও সম্পদ অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক ল্যাবরেটরি, ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করা প্রয়োজন। তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী দক্ষতা অর্জন ও বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর জন্য গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা ও ইন্ডাস্ট্রি সহযোগিতার মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের জন্যও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতা প্রয়োজন। এতে করে শিক্ষকরা নিজেদের গবেষণা ও শিক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবেন, যা দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।

এছাড়াও, পেশাগত শিক্ষা এবং ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা উচিত, যেন শিক্ষার্থীরা তাদের নির্দিষ্ট পেশায় নিয়োজিত হওয়ার আগে সেগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। যেমন, ডাক্তারদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাসের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা রয়েছে, যেন তারা তত্ত্বভিত্তিক শিক্ষা অর্জন করার পাশাপাশি বাস্তব জগতের চিকিৎসা সেবা প্রদানে দক্ষ হয়ে ওঠে।

এ ধরনের পেশাগত প্রশিক্ষণ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রকৌশলী, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ অথবা অন্যান্য পেশায় যারা যুক্ত হতে যাচ্ছে, তাদেরও সেই পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও ‘অন দ্য জব ট্রেনিং’ নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয় বরং শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে দক্ষ করে তোলার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে হবে।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন ইন্টার্নশিপে অংশ নেবে, তখন তারা শুধুমাত্র পেশাগত দক্ষতা অর্জন করবে না বরং সেই প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের ত্রুটি এবং প্রশাসনিক গাফিলতির মতো সমস্যাগুলো পর্যবেক্ষণ করেও একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবে। এই প্রতিবেদনগুলো গবেষণামূলক শিক্ষা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হলে, তা শুধু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিধি বৃদ্ধি করবে না বরং দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সহায়ক হবে।

এটি একটি দ্বৈত উপকারিতা হিসেবে কাজ করবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা তাদের পেশায় দক্ষ হয়ে উঠবে, অন্যদিকে তাদের গবেষণার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার দিকে আলোকপাত হবে, যা পরবর্তীতে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেশাগত প্রশিক্ষণ এবং ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সার্টিফিকেট প্রদানের আগে তাদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও গবেষণার পূর্ণতা নিশ্চিত করতে হবে।

অতএব, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নের জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। এর মাধ্যমে শুধু উচ্চশিক্ষার মানই বৃদ্ধি পাবে না বরং দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতেও তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একমাত্র গবেষণা ও উদ্ভাবনই বাংলাদেশকে ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করতে সাহায্য করবে এবং বিশ্বমঞ্চে প্রতিযোগিতার জন্য আমাদের শক্তি বাড়াবে।

অতএব, বিনয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি, যারা দেশের সর্বাঙ্গীণ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে নিয়োজিত আছেন, তাদের দয়া করে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।

আমি আশা করি, সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মহল দ্রুত এই প্রস্তাবিত সিদ্ধান্তের আলোকে একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, যা দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় একটি নবোদ্যম এবং প্রগতি নিয়ে আসবে। এটি শুধু শিক্ষার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে না, বরং দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের সক্ষমতাকে দৃঢ় করবে।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]

এমআরএম/এমএস

Read Entire Article