বেহাল সড়কে অতিষ্ঠ জীবন, বিপর্যস্ত চিকিৎসা ও চিংড়ি-পর্যটন ব্যবসা

1 month ago 7

* সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ
* খরচ বেড়েছে চিংড়ি ব্যবসায়ীদের
* রাস্তার ভয়ে যেতে চান ন সুন্দরবনের পর্যটকরা
* খোদ উপদেষ্টার অসন্তোষ

সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ হয়ে শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কটির করুণ দশায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বছরের পর বছর মেরামতের নামে চলছে প্রহসন, কিন্তু বাস্তবে ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। খানাখন্দে ভরা সড়কে প্রতিদিন লাখো মানুষ ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত এই মহাসড়ক এখন স্থানীয়দের কাছে যেন ‘ভোগান্তির প্রতীক’।

পথ নয়, যেন মৃত্যুর ফাঁদ

এই মহাসড়কের সবচেয়ে নাজুক অংশ সাতক্ষীরা সদরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন আলীপুর থেকে দেবহাটা উপজেলার সখিপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার। পিচ-খোয়া উঠে সৃষ্টি হয়েছে অগণিত গর্ত। কোথাও সড়ক ভেঙে গিয়ে খাঁজ তৈরি হয়েছে, যেন ছালচামড়া উঠে গেছে। সখিপুর থেকে কালিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশ ভেঙে গেছে। কোথাও কোথাও রাস্তা ঢেউয়ের মতো উঁচু-নিচু হয়ে আছে, ফলে যানবাহন চলতে গিয়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খায়। এমনকি কিছু স্থানে পিচের ওপরেই ইট বিছিয়ে নতুন রাস্তা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে, যা চলাচলের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

‘সাতক্ষীরা শহরের কোর্টে মামলা সংক্রান্ত কাজে গেলে এই রাস্তা পেরোতে হয়। কিন্তু সাতক্ষীরার নাম শুনলেই শরীর ব্যথা শুরু হয়। এমন ভোগান্তি আর কতদিন সহ্য করব?’

কালিগঞ্জ থেকে মৌতলা বাজার পর্যন্ত কিছুটা রাস্তা তুলনামূলক ভালো থাকলেও, মৌতলা থেকে শ্যামনগরের বংশিপুর বাজার পর্যন্ত অবস্থা একইরকম ভয়াবহ। পুরো সড়কে খানাখন্দ, ভাঙা। বাস-ট্রাকের চালকদের ভাষায়, এই রাস্তায় চলতে গাড়ি নয়, সাহস লাগে।

বেহাল সড়কে অতিষ্ঠ জীবন, বিপর্যস্ত চিকিৎসা ও চিংড়ি-পর্যটন ব্যবসা

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এ সড়কে একবার যাতায়াত করলে শরীর ব্যথা হয়ে যায়, ২-৩ দিন লাগে পুরোপুরি সুস্থ হতে।

শ্যামনগরের ভেটখালি গ্রামের বাসিন্দা হোসেন আলীর মতে, সাতক্ষীরা শহরের কোর্টে মামলা সংক্রান্ত কাজে গেলে এই রাস্তা পেরোতে হয়। কিন্তু সাতক্ষীরার নাম শুনলেই শরীর ব্যথা শুরু হয়। এমন ভোগান্তি আর কতদিন সহ্য করব?

চিংড়ি শিল্পে ধস, অর্থনীতিতে ক্ষতি

উপকূলীয় এই মহাসড়ক দিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান চিংড়ি উৎপাদন এলাকা মুন্সিগঞ্জ, কৈখালী, গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী থেকে প্রতিদিন পণ্য পাঠানো হয় খুলনা বা ঢাকায়। কিন্তু এখন রাস্তায় সময় লাগে দ্বিগুণ, খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ।

‘গাড়ি এমনভাবে কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল মাকে অ্যাম্বুলেন্সে না তুলে নৌকায় নিলেই ভালো হতো।’

শ্যামনগরের চিংড়ি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে সকালে পণ্য তোলার পর দুপুরে খুলনায় পৌঁছানো যেত। এখন সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়, অনেক সময় পচে যায় বা মান কমে যায়। এতে বিদেশি ক্রেতারা অভিযোগ করেন, দামও কম দেন।

বেহাল সড়কে অতিষ্ঠ জীবন, বিপর্যস্ত চিকিৎসা ও চিংড়ি-পর্যটন ব্যবসা

কালিগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঢাকা বা যশোর থেকে ট্রাক ডাকলে চালকরা বলে ওই রুটে গেলে গাড়ি ভেঙে যাবে। অনেকে দ্বিগুণ ভাড়া চায়। এতে আমাদের ব্যবসায় মার খাচ্ছে।

পথেই মৃত্যুর শঙ্কা রোগীদের

এই মহাসড়ক দিয়ে সাতক্ষীরায় যেতে হয় গুরুতর রোগীদের। কুলিয়ার ক্যানসার আক্রান্ত রোগী রহিমা খাতুনকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে বারবার গাড়ি থামাতে হয়েছে। তার ছেলে জামাল হোসেন বলেন, গাড়ি এমনভাবে কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল মাকে অ্যাম্বুলেন্সে না তুলে নৌকায় নিলেই ভালো হতো।

পর্যটন খাতে ধস

সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা থাকলেও এই রাস্তার কারণে তা প্রায় নিঃশেষ। ট্যুর গাইড আনিছুর রহমান বলেন, আগে অনেক পর্যটক আসত। এখন সবাই খুলনার দিকটাই বেছে নেয়। রাস্তার কথা শুনেই আসতে চায় না।

‘সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশ খুব সুন্দর, কিন্তু রাস্তায় যাওয়ার ভয়ে কেউ আসে না।’

স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী খালিদ হাসান বলেন, সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশ খুব সুন্দর, কিন্তু রাস্তায় যাওয়ার ভয়ে কেউ আসে না।

প্রশাসনের আশ্বাস, প্রকল্পের অগ্রগতি

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের সাতক্ষীরা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার পারভেজ জানান, সাতক্ষীরা থেকে ভেটখালী পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটি ছয়টি প্যাকেজে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে পাঁচটির টেন্ডার ও চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, প্রথম প্যাকেজ অনুমোদনের অপেক্ষায়।

বেহাল সড়কে অতিষ্ঠ জীবন, বিপর্যস্ত চিকিৎসা ও চিংড়ি-পর্যটন ব্যবসা

তিনি জানান, মোট ৬২ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন করা হবে, এর মধ্যে ৩৫ কিলোমিটার ৩৪ ফুট ও ২৭ কিলোমিটার ২৪ ফুট প্রশস্ত করা হবে। প্রাথমিক বাজেট ছিল ৬৯৩ কোটি টাকা, চূড়ান্ত চুক্তিমূল্য দাঁড়িয়েছে ৫৭০ কোটি টাকা। বর্ষা শেষে কাজ শুরু হবে।

নাগরিক সমাজের ক্ষোভ ও হুঁশিয়ারি

নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাহিমুল হক বলেন, এই সড়ক দিয়ে তিনটি উপজেলার লাখ লাখ মানুষ চলাচল করে, কিন্তু রাস্তাটি নিয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। জনগণকে বিভ্রান্ত করতে খণ্ড খণ্ড মেরামত দেখানো হচ্ছে। প্রয়োজনে বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে হবে।

‘এমন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের এই বেহাল দশা দুঃখজনক। শুধু যোগাযোগ নয়, দেশের ভাবমূর্তিও এতে জড়িত। দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।’

জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব আলী নূর খান বাবুল বলেন, এই সড়কটি শুধু তিনটি উপজেলার জীবনরেখা নয়, সুন্দরবন ও উপকূলীয় যোগাযোগেরও প্রধান মাধ্যম। আমরা আর প্রতিশ্রুতি চাই না, সম্পূর্ণ সংস্কার চাই।

বেহাল সড়কে অতিষ্ঠ জীবন, বিপর্যস্ত চিকিৎসা ও চিংড়ি-পর্যটন ব্যবসা

হতবাক উপদেষ্টা, দ্রুত সংস্কারের আশ্বাস

সম্প্রতি যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টাআসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া এই মহাসড়ক দিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণে যান। ভ্রমণ শেষে তিনি বলেন, ‘এমন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের এই বেহাল দশা দুঃখজনক। শুধু যোগাযোগ নয়, দেশের ভাবমূর্তিও এতে জড়িত। দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।’

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহম্মেদ জানান, ‘গত সরকারের সময় টেন্ডার হলেও অনিয়মের কারণে বাতিল হয়। এখন নতুন টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে, শিগগিরই পূর্ণমাত্রায় সংস্কার কাজ শুরু হবে।’

এফএ/জেআইএম

Read Entire Article