দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সামাজিক স্থিতিশীলতা ও একটি শক্তিশালী ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভালো ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবেন, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতি আনবে। তবে, এই লক্ষ্য অর্জনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্বল অবকাঠামো এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো বাধাগুলো দূর করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যবসা নিবন্ধনের ডিজিটালাইজেশনসহ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও অবকাঠামো, কর প্রক্রিয়া এবং চুক্তি বাস্তবায়নে এখনো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অর্থায়ন প্রাপ্তি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্বল অবকাঠামো, কর পরিশোধে হয়রানি এবং আইনগত জটিলতা এখনও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু জাগো নিউজকে বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আর ব্যবসার পরিবেশ সহজ করার উপায় হলো সমাজকে স্থিতিশীল করা। একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে দায়বন্ধ এমন একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করলে সমাজকে স্থিতিশীল রাখা যায়।
আগামীতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ওপর সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত এমন অভিমত দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো একটা রাষ্ট্রে প্রতিবছর ২০-২৫ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে আসে। সেখানে এই দেশের জন্য সব থেবে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলে আপনাকে আগে স্থিতিশীলতায় আসতে হবে।
আরও পড়ুন...
- টানা সাত কার্যদিবস পতনের পর ঊর্ধ্বমুখী শেয়ারবাজার
- প্রথম ১০ দিনেই ই-রিটার্ন দাখিল প্রায় ১ লাখ করদাতার
- দামে হাঁসফাঁস, ক্রেতার নাভিশ্বাস
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি এখনো অনেক বেশি। এর মধ্যে সমস্যা হলো খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি যখন বেশি হয়, তখন যারা গরিব তাদের ওপর চাপ বেশি পড়ে। সুতরাং মূল্যস্ফীতি কমানো এবং বিনিয়োগ বাড়ানো এটাই এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে ব্যবসার পরিবেশও ঠিক থাকে। তার মতে, একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারই ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে ভালো।
আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী ও ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম বলেন, বাংলাদেশে নতুন করে একটি ব্যবসা শুরু করতে চাইলে উদ্যোক্তাকে শুরুতেই নানা রকম জটিলতার মুখে পড়তে হয়। কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ, কর শনাক্তকরণ নম্বর এবং ভ্যাট নিবন্ধন এসব কাজের জন্য একাধিক দপ্তরে যেতে হয়। আর প্রতিটি ধাপেই সময়, শ্রম ও খরচের হিসাব বাড়ে।
তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সূচকে উন্নতি করতে হলে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- সহজ ও দ্রুত লাইসেন্স প্রাপ্তি। একটি নতুন ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে লাইসেন্স বা অনুমতি পেতে দীর্ঘ সময় লাগলে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। এর জন্য অনলাইন পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, কর ব্যবস্থা সহজীকরণ, নির্মাণ অনুমতি ও সম্পত্তি নিবন্ধন সহজ করা, সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ইত্যাদি সহজ হতে হবে।
তিনি জানান, জটিল কর আইন এবং উচ্চ কর হার ব্যবসার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তাই কর ব্যবস্থা সহজীকরণ এবং করের হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা প্রয়োজন। অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ করে উন্নত সড়ক, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বন্দর, সমন্বিত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি, দ্রুত সংযোগ স্থাপন, পরিবেশগত অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দ্রুত করা, বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা, দেউলিয়া আইন সংস্কার এবং অন্যান্য অবকাঠামো ব্যবসার প্রসারে সহায়তা করে। সরকার ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালুসহ বেশ প্রক্রিয়াকে ডিজিটালাইজের পদক্ষেপ নিলেও এখনো অনেক কিছু করার আছে।
সাকিফ শামীম জানান, আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হতে পারলে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সবচেয়ে বেশি নজর দেবেন। এছাড়া দেশের সকল চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের জন্য এফবিসিসিআইতে একটি সুনির্দিষ্ট ডাটাবেজ সংরক্ষণ করা হবে। এর মাধ্যমে কোনো অ্যাসোসিয়েশন বা চেম্বারের কী সমস্যা হচ্ছে অথবা খাতভিত্তিক ব্যবসায়ী- উদ্যোক্তাদের কী ধরনের সেবা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা সহজতর হবে এবং চাহিদা অনুযায়ী তা দ্রুত সমাধান করার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তিনি।
তিনি বলেন, এ সকল সংস্কার করার জন্য বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। বেসরকারি খাত যত বেশি শক্তিশালী হবে সরকারের রাজস্ব বা আয় ততই বৃদ্ধি পাবে। এজন্য এফবিসিসিআই-কে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অ্যাসোসিয়েশন ও জেলা চেম্বারগুলোর উন্নয়নে প্রতিবছর বাজেট ঘোষণা করতে হবে।
তার মতে, সকল বাণিজ্য সংগঠনকে কার্যকর করতে হলে জাতীয় বাজেট থেকে এফবিসিসিআইয়ের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া অত্যাবশ্যক। এটা সরকারের কাছে আমরা প্রস্তাব করব।
সাকিফ শামীম বলেন, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) জোর দেওয়া, ব্যাংক সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং এক্ষেত্রে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা তিন মাসের জায়গায় ছয় মাস কিংবা এক বছর করা, ডিভিসি অডিট রিপোর্ট প্রদানে বাণিজ্য সংগঠনকে সময় দেওয়া এবং কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা, ভ্যাটের হার সাড়ে ৭ ভাগ থেকে নামিয়ে ৫ শতাংশ করার মতো উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়েছে।
এখনো কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি রয়ে গেছে উল্লেখ করে সাকিফ শামীম বলেন, ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া এখনো বেশ জটিল। এছাড়া আইন-কানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো সুবিধা, শ্রম নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায় বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও উন্নতি করার অবকাশ রয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আনতে বিশ্বাসযোগ্যতা, ধারাবাহিকতা ও অর্থনেতিক সক্ষমতা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে নতুন কোম্পানির ব্যবসা শুরু করতে ২৩টি দপ্তরের ১৫০টি অনুমোদনের প্রয়োজন হয় যা সময় সাপেক্ষ এবং জটিল।
রাজস্ব আয় বাড়াতে কর হার সহনিয় পর্যায়ে রাখা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতে এনবিআর-কে আরো উদ্যোগী হতে হবে। করজালের আওতা বাড়িয়ে করহার কমিয়ে দিলে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। প্রতি বছর করের হার বৃদ্ধির ফলে যারা নিয়মিত কর দিচ্ছে তাদের ওপর চাপ বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে, সকল ব্যবসায়ীকে করের আওতায় আনার জন্য সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কীভাবে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি করা যায় তা বিডাকে (বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) খুঁজে বের করতে হবে। এসব বিষয় সমাধান করা হলে, দেশে ব্যবসাবান্ধব সুযোগ উন্নত হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে এবং ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের উন্নতি অপরিহার্য। সরকারের নীতিগত সহায়তা, অবকাঠামোর উন্নয়ন, এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যবসার গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এমএএস/কেএইচকে/এমএস