ব্যাংক ঋণ পরিশোধে মনোযোগী সরকার

2 days ago 5

সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নতুন করে ঋণ নেওয়ার চেয়ে পুরোনো ঋণ পরিশোধে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সরকারি ঋণ কমেছে ৪২৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ঋণ বেড়েছিল ৩ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা, এবার উল্টো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। 

সংশ্লিষ্টদের মতে, উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় স্থবির থাকায় সরকার ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বরাদ্দের মাত্র ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ অর্থ খরচ করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। দেশের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে কম বাস্তবায়নের রেকর্ড।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুযায়ী, সরকারের মোট বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। কিন্তু জুলাই ও আগস্ট দুই মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৭১৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়ন ছিল ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৭ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানেও এই প্রবণতা স্পষ্ট। তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকায়। গত জুন শেষে যা ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে ঋণ কমেছে ৪২৭ কোটি টাকা।

এই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে সরকারের ঋণ কমেছে ৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরকারের ঋণস্থিতি দাঁড়ায় ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের মোট ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ৫২০ কোটি টাকায়, যা গত জুনে ছিল ৯২ হাজার ৫১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেনের জন্য দুটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে—‘ওয়েস অ্যান্ড মিনস’ এবং ‘অ্যাডভান্স’। এগুলো মূলত অস্থায়ী ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ সুবিধা, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে দেয় যখন রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সাময়িক ঘাটতি দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো মাসে সরকারের ব্যয় আয়কে ছাড়িয়ে গেলে এই ঘাটতি পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্প মেয়াদি অর্থ নেওয়া হয়।

তিনি আরও জানান, আইএমএফের ঋণ বা সহায়তার অর্থ সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে জমা হয়। সেখান থেকে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ গ্রহণ করে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ বেড়ে গেলেও তা নতুন টাকা ছাপানোর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

অর্থনীতিবিদদের মতে, উন্নয়ন ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় সরকারের ঋণ গ্রহণ কমেছে, যা সাময়িকভাবে ব্যাংক খাতে চাপ কমাতে সাহায্য করছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের হার না বাড়লে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।

চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিট এক লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকার নিট ৭২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল—যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ওই বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটি কম ছিল ২৬ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, বর্তমান সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট কমানো। এজন্য ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ না নিয়ে, বিদ্যমান দায় পরিশোধে অগ্রাধিকার দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে সরকার ব্যাংকের কাছে ঋণগ্রহীতা না হয়ে ধীরে ধীরে পরিশোধকারী অবস্থানে যাচ্ছে—যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক সংকেত।

Read Entire Article