বড় হচ্ছে কেক-পেস্ট্রির বাজার, বছরে ৭৫০ কোটি টাকার ব্যবসা

1 day ago 5

বছর ঘুরে চলে আসে শীত। এ সময় বিয়ে, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, বিজয় দিবস, বড়দিন, নতুন বছরের শুভেচ্ছা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ বিভিন্ন ধরনের উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠান বেশি হয়। এসব উৎসব-অনুষ্ঠান উদযাপনে প্রয়োজন পড়ে কেকের। কেক কাটা ও কেক উপহার দেওয়া নতুন এক সংস্কৃতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ফলে রাজধানীসহ দেশের হাট-বাজারে গড়ে উঠেছে নানান ধরনের কেক ও পেস্ট্রির দোকান। এসব দোকানে ভ্যানিলা, চকলেট, স্ট্রবেরি, বাটার স্কচসহ বিভিন্ন ফ্লেভার, আকার ও রঙের কেক পাওয়া যায়। এছাড়া ঘরে তৈরি কেক ও কেকজাতীয় পণ্যের চাহিদা ও বিক্রি বেড়েছে বহুগুণ।

খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে কেক ও পেস্ট্রির দোকানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার, যেখানে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করে। কেকের বাজার প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসে নানান ধরনের অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক কেকের চাহিদা থাকে। এছাড়া করপোরেট সেক্টরে অনেকে উপহার হিসেবে কেক দেন।

‘আমরাই বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক কেক, পেস্ট্রির দোকান চালু করি। বাংলাদেশে কেকের বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামজুড়ে আমাদের প্রায় ৫০টি আউটলেট আছে, যেখানে ৫০০’র বেশি মানুষ কাজ করছে।’ কুপার্সের বিপণন প্রধান রাকিবুর রহমান

পুরান ঢাকার প্রিন্স অফ ওয়েলস বেকারি অ্যান্ড কনফেকশনারি, আনন্দ কনফেকশনারি ও ইউসুফ কনফেকশনারি শত বছর ধরে কেক, বিস্কুটসহ বিভিন্ন বেকারি আইটেম বিক্রি করে। কিন্তু কেক ও পেস্ট্রি শপের আধুনিক ধারণাটি প্রবর্তন করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশ সৈনিক ডগলাস জে এ কুপার।

১৯৮৪ সালে ডগলাস জে এ কুপার ও তার বাংলাদেশি স্ত্রী সুফিয়া কুপার ঢাকার কলাবাগানে এক হাজার বর্গফুটের একটি কারখানা স্থাপন করে কুপার্সের যাত্রা শুরু করেন।

ব্র্যান্ডটির বিপণন প্রধান রাকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরাই বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক কেক, পেস্ট্রির দোকান চালু করি। বাংলাদেশে কেকের বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামজুড়ে আমাদের প্রায় ৫০টি আউটলেট আছে, যেখানে ৫০০’র বেশি মানুষ কাজ করছে।’

বড় হচ্ছে কেক-পেস্ট্রির বাজার, বছরে ৭৫০ কোটি টাকার ব্যবসা

‘তবে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বিক্রি কিছুটা কম। তবু আশা করছি নতুন বছরে আমরা আরও বেশি বিক্রি করতে পারব।’ বলেন রাকিবুর রহমান।

‘আমাদের সাধারণ দিনে যে পরিমাণ কেক বিক্রি হয় তার চেয়ে ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পাঁচ গুণ বেশি বিক্রি হয়। গত ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি আমরা আমাদের ক্যাপাসিটির চেয়ে বেশি কেক সাপ্লাই দিয়েছি।’- টেস্টি ট্রিটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্র্যান্ড ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ শাওন

বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ টেস্টি ট্রিটের দখলে

কেক ও পেস্ট্রি বাজারের অন্যতম পরিচিত নাম টেস্টি ট্রিট। ২০১৪ সালে চালু হওয়া টেস্টি ট্রিটের বর্তমানে সারাদেশে ৪২৭টি শাখা আছে, যেখানে প্রায় দুই হাজার কর্মী কাজ করেন।

টেস্টি ট্রিটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্র্যান্ড ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ শাওন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কেক ও পেস্ট্রির বর্তমান বাজার প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার। দেশের মোট বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ টেস্টি ট্রিটের দখলে। সারা বছরই আমাদের কেকের চাহিদা থাকে। তবে শীতের সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠান থাকায় এই সময় আমাদের কেকের অর্ডার বেশি থাকে। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসে ভালোবাসা দিবসে অনেক কেক বিক্রি হয়।’

বড় হচ্ছে কেক-পেস্ট্রির বাজার, বছরে ৭৫০ কোটি টাকার ব্যবসা

‘আমাদের সাধারণ দিনে যে পরিমাণ কেক বিক্রি হয় তার চেয়ে ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পাঁচ গুণ বেশি বিক্রি হয়। গত ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি আমরা আমাদের ক্যাপাসিটির চেয়ে বেশি কেক সাপ্লাই দিয়েছি।’ বলছিলেন আরিফ মাহমুদ শাওন।

‘মিঠাইকে মানুষ আসলে মিষ্টি হিসেবে চেনে। তবে বর্তমানে কেক বিক্রিতে আমাদের প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ। কেক ও পেস্ট্রি বাজারে আমাদের মার্কেট শেয়ার প্রায় ছয় শতাংশ। আমাদের লক্ষ্য এটি ১৫ শতাংশে উন্নীত করা। গত ছয় মাসে আমাদের কেক বিক্রি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কারণ আমাদের কেকের টেস্ট ও মান দুটোই উন্নত করতে পেরেছি।’- মিঠাই’র অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্র্যান্ড ম্যানেজার মাসুম বিল্লাহ

প্রবৃদ্ধি বাড়ছে মিঠাইয়ের

কেক ও পেস্ট্রি বাজারে আরেক সুপরিচিত নাম মিঠাই। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরুর পর শুরুতে মিষ্টির ব্যবসার দিকে মনোযোগ দিলেও এখন মিষ্টির পাশাপাশি কেক ও পেস্ট্রি বাজারেও বেশ সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করছে মিঠাই।

রোববার (৫ জানুয়ারি) রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর সেকশনে মিঠাই’র আউটলেটে গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ত সময় পার করছেন বিক্রেতারা।

বড় হচ্ছে কেক-পেস্ট্রির বাজার, বছরে ৭৫০ কোটি টাকার ব্যবসা

ব্র্যাঞ্চটির শিফট ইনচার্জ কাওসার আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আমাদের প্রচুর কেক সেল হচ্ছে। বিশেষ করে নিউ ইয়ার উপলক্ষে কেকের চাপ বেশি ছিল। যেমন- আজ সকাল থেকে ১৫টা কেক সেল হয়েছে। আমাদের বেস্ট সেলিং কেক হচ্ছে চকলেট ব্ল্যাক ফরেস্ট।’

মিঠাই’র অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্র্যান্ড ম্যানেজার মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘মিঠাইকে মানুষ আসলে মিষ্টি হিসেবে চেনে। তবে বর্তমানে কেক বিক্রিতে আমাদের প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ। কেক ও পেস্ট্রি বাজারে আমাদের মার্কেট শেয়ার প্রায় ছয় শতাংশ। আমাদের লক্ষ্য এটি ১৫ শতাংশে উন্নীত করা। গত ছয় মাসে আমাদের কেক বিক্রি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কারণ আমাদের কেকের টেস্ট ও মান দুটোই উন্নত করতে পেরেছি।’

‘বর্তমানে আমাদের প্রায় ২০০ আউটলেট আছে, যেখানে ৮০০ কর্মী কাজ করেন। আগামী জুনের মধ্যে আরও ৫০টি আউটলেট চালু করতে চাই। আগামী দুই বছরে আউটলেট সংখ্যা ৫০০তে উন্নীত করতে কাজ করছি। আমরা সব আউটলেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে কেক সাপ্লাই দিচ্ছি, যাতে শর্টেজ না হয়। সুইট শপ থেকে সুইট অ্যান্ড বেকারির দিকে ব্যবসাটা প্রসারিত করতে চাচ্ছি।’ বলছিলেন মাসুম বিল্লাহ।

মিরপুর-১৩ রাকিন সিটি সংলগ্ন ওয়েল ফুড আউটলেট ঘুরে দেখা যায়, সেখানে বিভিন্ন ফ্লেভারের কেক সাজানো আছে।

ব্র্যাঞ্চটির সেলস ম্যানেজার রাফি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ব্র্যাঞ্চটা সুপারশপের সঙ্গে হওয়ায় তেমন একটা সেল হয় না। তবে নতুন বছর উপলক্ষে গত কয়েকদিন মোটামুটি সেল ছিল। এখন এভারেজ চলছে।’

‘কেক ছাড়া কোনো উৎসব পালন করা এখন প্রায় অকল্পনীয় ব্যাপার। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আপনজনের সঙ্গে সুন্দর মুহূর্তগুলো আরও বেশি স্পেশাল করতে কেকের কোনো তুলনা নেই।’- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিফা তাসনিম

কেক-পেস্ট্রির দোকান বাড়ছে

সারাদেশে প্রতিনিয়ত কেক ও পেস্ট্রির দোকান বেড়েই চলছে। প্রতিদিন নতুন নতুন দোকান চালু হচ্ছে। দুই বছর আগেও পান্থপথের মতো ব্যস্ত এলাকায় ১২ থেকে ১৫টি কেক ও পেস্ট্রির দোকান ছিল, যা এখন ২৫-৩০টি।

বেকারি ব্র্যান্ড ব্রেড অ্যান্ড বিয়ন্ডের পান্থপথ শাখার একজন বিক্রয় কর্মী জাগো নিউজকে জানান, গত ২৯ ডিসেম্বর কেবল এই শাখা থেকেই ৪০টি কেক বিক্রি হয়েছে।

ব্রেড অ্যান্ড বিয়ন্ডের একজন ক্রেতার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর এই সময়ে আমি প্রায় প্রতিদিনই এখান থেকে কেক কিনি। বাচ্চার বন্ধুদের জন্মদিন, কোথাও বেড়াতে গেলে অথবা কোনো সেলিব্রেশনে কেক ছাড়া তো চলেই না।’

‘কেক ছাড়া কোনো উৎসব পালন করা এখন প্রায় অকল্পনীয় ব্যাপার। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আপনজনের সঙ্গে সুন্দর মুহূর্তগুলো আরও বেশি স্পেশাল করতে কেকের কোনো তুলনা নেই’, বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিফা তাসনিম।

সাধারণত ৫০০ গ্রাম ওজনের একটি কেক ৮০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু গ্রাহকের চাহিদা মতো কাস্টমাইজড কেক হলে দাম শুরু হয় দুই হাজার টাকা থেকে। বছরের শেষ দিন (৩১ ডিসেম্বর), প্রথম দিন (১ জানুয়ারি) এবং ভালোবাসা দিবসে সবচেয়ে বেশি কেক বিক্রি হয়।

লাইভ বেকারি ও অনলাইনেও কেক বিক্রি

বর্তমানে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে লাইভ বেকারির প্রচলন শুরু হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের বেকারি আইটেম পাওয়া যায়। সেখানে বিভিন্ন দামের কেক পাওয়া যায়। তবে সেগুলো বেকারি বা পিস কেক। এছাড়া ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন পেজে সহজেই ঘরের তৈরি কেক অর্ডার করা যায় এবং এর মাধ্যমে অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে।

এমনই একজন নারী উদ্যোক্তা সুমনা আক্তার। কাজ করছেন মিরপুরের বর্ধিত পল্লবী এলাকা থেকে। রান্নাবান্নার প্রতি বরাবরই আগ্রহ ছিলো তার। বেকারি আইটেমও ভালো বানাতে পারেন। উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠেন করোনা মহামারির সময়।

সুমনা আক্তার বলেন, ‘২০২০ সালে আমার যাত্রা শুরু হয় কেক নিয়ে। প্রথমে আত্মীয়-স্বজনদের কেক খাওয়াই। তাদের সবার উৎসাহে ফেসবুকে সুমনা’স ফুড নামে পেজ খুলি এবং আশেপাশে সবাইকে জানাই আমার উদ্যোগের কথা। আর এভাবে আমার কেক নিয়ে কাজের শুরু। আলহামদুলিল্লাহ এরপর আর পিছে তাকাতে হয়নি।’

বিভিন্ন ফ্লাভারের কেক, কাপ কেক, পাউন্ড কেক, কাস্টমাইজড কেক নিয়ে কাজ করছেন সুমনা আক্তার। তাছাড়া ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ীও কেক তৈরি করে দেন। এক পাউন্ড ভেনিলা কেকের দাম ৭০০ টাকা, চকলেট কেক ৮০০ টাকা। তাছাড়া কেকের ধরন অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়। কেকের পাশাপাশি সব ধরনের খাবার নিয়েও কাজ করছেন তিনি। ফুড অ্যান্ড বেভারেজ প্রডাকশন লেভেল ৩ সার্টিফিকেট পেয়েছেন।

আরেকজন নারী উদ্যোক্তা লাইলা ফারহানা। তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে থাকেন। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে করোনা মহামারির সময় তিনি তার কেকের ব্যবসা শুরু করেন।

লাইলা ফারহানা জাগো নিউজকে বলেন, “বেকারি নিয়ে কাজ করব এরকম চিন্তা ছিল না। শুরুতে রান্নাবান্না নিয়ে কাজ করব এরকম চিন্তা ছিল। তখন অনলাইনে একজন শেফের ক্লাস করলাম, শিখলাম, ভালো লাগল। তারপর ধীরে ধীরে কেকের ওপর বেশি আগ্রহ তৈরি হলো। এরপর একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কেক বানানোর ওপর ফুল কোর্স করলাম, পরীক্ষা দিলাম। এখন ফেসবুকে ‘রান্না বিলাস’ নামে একটি পেজের মাধ্যমে কেক বিক্রি করছি। অফলাইনেও বিক্রি করি।”

‘আমার উদ্যোগটা ভালোভাবে প্রচার করতে পারিনি। পরিচিত যারা আছেন তাদের মাধ্যমেই রিপিট কাস্টমার আসে। ৫০০ গ্রাম থেকে চার কেজি পর্যন্ত যে কোনো ফ্লেভারের কেক পাওয়া যায়। ৫০০ গ্রাম ওজনের ভ্যানিলা ফ্লেভারের কেক ৭৫০ টাকা, চকলেট ফ্লেভারের কেক ৮৫০ টাকা থেকে শুরু। এছাড়া কাস্টমাইজ করার সুযোগ আছে, তখন খরচ একটু বাড়বে। আমার এখানে চকলেট, বাটারস্কচ বেশি চলে।’ বলছিলেন লাইলা ফারহানা।

এসআরএস/এমএমএআর/এমএস

Read Entire Article