ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে ইসরায়েলি সেনারা বড় আকারে বিমান হামলা চালিয়েছে। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) ভোররাতে সেহরির সময় কোনো সতর্ক সংকেত ছাড়েই ইসরায়েলি সেনারা গাজার বিভিন্ন এলাকায় ভয়ানক বিমান হামলা চালায়, যা ছিল অত্যন্ত তীব্র এবং ভয়াবহ।
ইসরায়েলের এই ন্যক্কারজনক হামলায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৩০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেক নারী এবং শিশু রয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে এই হামলার প্রতি বিভিন্ন দেশ, সংগঠন এবং জনগণের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। বিশেষ করে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস এই হামলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে যে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
হামাসের মতে, ইসরায়েল এই হামলার মাধ্যমে গাজায় বন্দি অবশিষ্ট ইসরায়েলি জিম্মিদের ‘অজানা ভাগ্যের’ দিকে ঠেলে দিয়েছে। হামাসের কর্মকর্তা ইজ্জত আল-রিশেক এক বিবৃতিতে বলেন, গাজায় পুনরায় যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত হলো দখলদারদের বন্দিদের বলিদান এবং তাদের ওপর মৃত্যুদণ্ড আরোপের সিদ্ধান্ত।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, হামাস বারবার তাদের জিম্মিদের মুক্তির জন্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এই হামলা চালানো হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছেন, যতক্ষণ না আমাদের জিম্মিদের বাড়ি ফেরানো হয় এবং সব লক্ষ্য অর্জন না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা লড়াই বন্ধ করব না।
এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলের হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে যে, তারা হামাস, হুতি এবং ইরানসহ সমস্ত যে কোনো গোষ্ঠী যারা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট বলেছেন, গাজায় হামলার বিষয়ে ইসরায়েল আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছে এবং ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, যারা এই হামলার বিরুদ্ধে আমাদের আতঙ্কিত করতে চায়, তাদের সবাইকে ফলভোগ করতে হবে।
এদিকে ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবারও এই হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। হোস্টেজ অ্যান্ড মিসিং ফ্যামিলিজ ফোরাম তাদের সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছে যে, গাজায় ইসরায়েলি সরকারের আক্রমণের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, তারা ‘জিম্মিদের মুক্ত করতে আন্তরিক নয়’।
তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, হামাসের ভয়াবহ বন্দিদশা থেকে আমাদের প্রিয়জনদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে ফেলায় আমরা স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ এবং আতঙ্কিত।
এই পরিস্থিতিতে, বিশ্বের অন্য দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াও এসেছে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং বলেছে, গাজায় ইহুদি শত্রুদের পুনরায় আগ্রাসনের নিন্দা জানাই। ফিলিস্তিনি জনগণ একা নয়, ইয়েমেন তাদের সহায়তা করবে।
চীনও এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে যে, গাজায় পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে এমন যেকোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং সব পক্ষকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, সব বেসামরিক নাগরিককে রক্ষা করতে হবে।
বেলজিয়ামের উপ-প্রধানমন্ত্রী ম্যাক্সিম প্রিভোটও হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং যুদ্ধবিরতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
রাশিয়া এবং জাতিসংঘও পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং শান্তির জন্য সব পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের অনুরোধ জানিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি ভেঙে ভয়ানক এই হামলা নিয়ে বিশ্লেষকরা জানান, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে চাইছেন, যাতে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় স্থল অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং তারা জানিয়েছে যে, হামলা অব্যাহত থাকবে এবং তা শুধু বিমান হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
জাতিসংঘে ইসরায়েলি দূত ড্যানি ড্যানন জানিয়েছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত হামাসের হাতে থাকা শেষ জিম্মি মুক্ত হচ্ছে না, ততক্ষণ ইসরায়েল থামবে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছে, যা আগামীকাল অনুষ্ঠিত হবে।
এই পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে এবং সেখানে সাধারণ মানুষ আরও ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে।
সূত্র : বিবিসি, আল-জাজিরা এবং রয়টার্স