ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

1 month ago 10

শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরঘাট এলাকায় কয়েক দফা ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার। তাদের কাছে নেই এখন পর্যাপ্ত খাবার, জামা-কাপড় এমনকী থাকার জায়গাও। কেউ শেষ সম্বল রক্ষা করতে না পারায় শোবার জন্য কুড়িয়ে ফিরছেন পরিত্যক্ত বস্তাও। এমন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। দ্রুততম সময়ের মধ্যে খাবার সরবরাহ ও পুনর্বাসন করতে না পারলে এলাকাজুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্র জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা এলাকার ওপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত। পদ্মা সেতু এলাকার পদ্মা নদীর তীরের নিকটবর্তী এলাকায় পদ্মা সেনানিবাস, জাজিরা ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এসব অবকাঠামো ভাঙনের হাত থেকে রক্ষায় ২০১২ সালে ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই কিলোমিটার নদীর তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে সেতু কর্তৃপক্ষ। তবে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে স্রোত বাঁধের দিকে ধাবিত হয়। এতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে পুরো বাঁধটি। যা সমীক্ষা করে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।

ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

এরপর গত বছরের নভেম্বরে প্রথম ওই বাঁধের নাওডোবা জিরো পয়েন্ট এলাকায় শুরু হয় ভাঙন। এতে বাঁধের ১০০ মিটার অংশে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এরপর চলতি বছরের ৭ জুন, ৭ জুলাই, ৯ জুলাই, ২৩ জুলাই, সবশেষে ৩১ জুলাই কয়েক দফা ভাঙনে বাঁধটির অন্তত ৭৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ভাঙনে ওই বাঁধের পাশে আলম খারকান্দি, ওছিম উদ্দিন মাদবরকান্দি, উকিল উদ্দিন মুন্সিকান্দি এবং মাঝির ঘাট এলাকার অন্তত ৩০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ৫০টি বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে আরও শতাধিক ঘরবাড়ি সরিয়ে নেন স্থানীয়রা। ভাঙন বাড়ায় অন্তত ৬০০ পরিবার এবং মাঝিরঘাট বাজারের ২০০টির বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিতে রয়েছে।

‘আমার জীবনডা গেলো দুঃখে দুঃখে। ছোটবেলা বাবা-মা মরছে। ৩২ বছর আগে স্বামীরে হারাইছি। অনেক কষ্ট করা মানষের বাসায় কাম কইরা থাকার জন্য ছোট একটা ঘর করছিলাম। আমার সেই থাকায় জায়গাডা আর ঘরটাও চোখের সামনে নদীতে লইয়া গেলো। এখন আমার কিছুই নাই। ছিঁড়া কয়ডা বস্তা টোকাইয়া লইছি রাইতে শোয়ার জন্য। সরকার যদি খাওন আর থাকার ব্যবস্থা না করে আমার মরা ছাড়া কোনো গতি নাই।’

ভাঙন ঠেকাতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ভাঙনকবলিত স্থানে বালুভর্তি জিওব্যাগ ও জিওটিউব ডাম্পিং করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ পর্যন্ত ওই এলাকায় এক লাখ ২০ হাজার জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। তাতে ব্যয় হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। তবে ভাঙনের ফলে সেগুলোও কোনো কাজে আসেনি। সেই জিওব্যাগসহ নদীর তীর ভেঙে আরও ১৫০ মিটার ভেতরে প্রবেশ করেছে।

ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

জাজিরার অছিম উদ্দিন মাদবর কান্দি এলাকা। ভাঙনকবলিত স্থান থেকে একটু অদূরেই নদীর জলে সযত্নে কয়েক টুকরা পরিত্যক্ত ছেঁড়া জিওব্যাগ ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছিলেন সত্তরোর্ধ্ব শিরিনা বেগম। ভাঙনে কিছুই রক্ষা করতে না পেরে কুড়ানো জিওব্যাগের ছেঁড়া অংশগুলোই এখন একমাত্র সহায়-সম্বল স্বামীহারা এই নারীর। এমন নিদারুণ কষ্টে সরকারের সহযোগিতার দাবি তার।

ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

শিরিনা বেগম বলেন, ‌‘আমার জীবনডা গেলো দুঃখে দুঃখে। ছোটবেলা বাবা-মা মরছে। ৩২ বছর আগে স্বামীরে হারাইছি। অনেক কষ্ট করা মানষের বাসায় কাম কইরা থাকার জন্য ছোট একটা ঘর করছিলাম। আমার সেই থাকায় জায়গাডা আর ঘরটাও চোখের সামনে নদীতে লইয়া গেলো। এখন আমার কিছুই নাই। ছিঁড়া কয়ডা বস্তা টোকাইয়া লইছি রাইতে শোয়ার জন্য। সরকার যদি খাওন আর থাকার ব্যবস্থা না করে আমার মরা ছাড়া কোনো গতি নাই।’

শিরিনা বেগমের মতো একই দশা ওই এলাকার শতাধিক পরিবারের। ভাঙনে কেউ হয়েছেন নিঃস্ব। কেউবা আবার আতঙ্কে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়ে হয়েছেন বাপ-দাদার ভিটা ছাড়া। কোথায় দাঁড়াবেন, কী খাবেন জানেন না তারা। পেটে ক্ষুধা আর মাথাগোঁজার ঠাঁই না হওয়ায় তাদের জীবন যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে ভাঙন ঠেকানোর পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে খাদ্য ও পুনর্বাসনের দাবি পরিবারগুলোর।

‘কোনোমতে পোলাপানডিরে লইয়া ঘর থেকে বাইর হইয়া জীবন রক্ষা করছি। আমার তিনটা ঘরের একটাও রক্ষা করতে পারি নাই। এখন আমাদের কাছে কোনো খাবার নাই। বাচ্চাগো মুখে যে খাবার তুলে দিমু তারও ক্ষমতা নাই। সরকার যদি আমাগো কিছু খাওন আর থাকার জন্য জায়গা দিতো, আমরা তাইলে বাঁচতে পারতাম।’

স্থানীয় আবুল বাসার মাদবর জাগো নিউজকে বলেন, ‘কয়ডা টিন আর কয়ডা কাঠ রক্ষা করতে পারছি, কিন্তু সেগুলো নিয়া রাখমু কই? রাস্তার ধারেই ফালাইয়া রাখছি। সরকার থেকে যদি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে, তাহলে হয়তো মাথাগোঁজার ঠাঁই হইবো। নাইলে আমাগো বৃষ্টিতে ভিজেই থাকতে হইবো।’

ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

সোনিয়া আক্তার নামের এক নারী বলেন, ‘কোনোমতে পোলাপানডিরে লইয়া ঘর থেকে বাইর হইয়া জীবন রক্ষা করছি। আমার তিনটা ঘরের একটাও রক্ষা করতে পারি নাই। এখন আমাদের কাছে কোনো খাবার নাই। বাচ্চাগো মুখে যে খাবার তুলে দিমু তারও ক্ষমতা নাই। সরকার যদি আমাগো কিছু খাওন আর থাকার জন্য জায়গা দিতো, আমরা তাইলে বাঁচতে পারতাম।’

এদিকে ক্রমাগত চেষ্টা করেও ভাঙন ঠেকাতে কুলিয়ে উঠছেন পারছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড। পুরোপুরি ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ তারেক হাসান।

ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

তিনি বলেন, ‘আমরা আপদকালীন কাজ করছি। কিন্তু পদ্মা নদীতে যেই স্রোত, ভাঙন পুরোপুরি থামানো সম্ভব না। ভাঙন প্রতিরোধের একটিই ব্যবস্থা, সেটি হলো স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আমরা এরইমধ্যে সে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। প্রকল্প অনুমোদন শেষে আমরা কাজ শুরু করতে পারবো।’

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছেন শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম।

ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

তিনি বলেন, ‘জাজিরায় কোথায় কোথায় খাস জমি রয়েছে তা খুঁজে বের করতে উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা নদীতে সব হারিয়েছে তাদের তালিকা তৈরি করে সেসব জায়গা দেওয়া হবে। যাদের জায়গা রয়েছে কিন্তু ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, তাদের জন্যও টিনসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।’

এসআর/এএসএম

Read Entire Article