অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ বড় নাকি ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ? কোনটার আবেদন বেশি? কোন লড়াইটির আকর্ষণ বেশি? কোন দুই দলের খেলা ক্রিকেট অনুরাগিদের বেশি টানে?
এক সময় তা নিয়ে বিতর্ক হতো। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের সাথে দক্ষিণ এশীয় প্রচার মাধ্যমের রীতিমত কলম যুদ্ধ চলতো। কারণ, পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম সব সময়ই মনে করতো যে, ইংলিশ আর অসিদের ক্রিকেট লড়াই বড়। এ লড়াইয়ে আভিজাত্য, মর্যাদা, আকর্ষণ, উত্তেজনা আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা সবই বেশি।
অ্যাশেজকে অনেক বেশি জনপ্রিয় দ্বৈরথ বলেও মনে করতো পশ্চিমা মিডিয়া। অন্যদিকে দক্ষিণ এশীয় প্রচার মাধ্যম বরাবরই ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট লড়াইকে এগিয়ে রাখতো। তাদের কাছে ভারত আর পাকিস্তান ক্রিকেট লড়াই অনেক বড় বলে গণ্য হতো। দেখানোর কারনও ছিল।
কঠিন বাস্তবতা হলো এক সময় অভিন্ন ভূখন্ড থাকলেও সেই ৪৭-এ দেভাগের পর থেকেই ভারত এবং পাকিস্তান চির শত্রুতে পরিণত। ভৌগলিক সীমাররেখা, কাশ্মির ইস্যু আর রাজনৈতিক বৈরিতা নিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক শুরু থেকেই খারাপ। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ আর সীমান্তে উত্তেজনা লেগেই থাকে। সংঘর্ষ, গোলাগুলিও হয় মাঝে মধ্যেই। ভারত ও পাকিস্তান তাই রীতিমত শত্রুতে পরিণত হওয়া দুটি দেশ।
সেই দু’দেশের নাগরিকদের কাছে তাদের পরস্পর ক্রিকেট লড়াই শুধু তেরঙ্গা আর সবুজ-সাদা পতাকার ব্যাট ও বলে লড়াই নয়, নিচক লড়াই ছাপিয়ে দুটি কাছাকাছি অবস্থানের অথচ রাজনৈতিক শত্রু ভাবাপন্ন দেশের ক্রিকেট যুদ্ধ বলেই পরিগণিত হতো। এবং একটা ‘মার মার, কাট কাট’ অবস্থা তৈরি হতো।
সেই লড়াইয়ে উত্তেজনা, আকর্ষণ আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাও থাকতো সর্বোচ্চ। দু’দেশের ক্রিকেট দল প্রায় কাছাকাছি ও সমান শক্তির বলে লড়াইটাও হতো জমজমাট। সেই লড়াইয়ের জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বীতার ঢেউ আছড়ে পড়তো আশপাশের দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত এবং সিঙ্গাপুরেও। শুধু তাই নয়, পুরো ক্রিকেট বিশ্বই বুঁদ হয়ে থাকতো এই লড়াইয়ের মাঝে। সব মিলিয়ে ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ প্রাণভরে উপভোগ করতো সবাই।
সেই ৭০ ও ৮০’র দশকে পাকিস্তানে যখন মাজিদ খান, জহির আব্বাস, জাভেদ মিয়াঁদাদ, মুশতাক মোহাম্মদ, আসিফ ইকবাল, ওয়াসিম বারি, সারফরাজ নাওয়াজ ও ইমরান খানের মত নামী ক্রিকেটাররা খেলতেন, একই সময়ে ভারতে সুনিল গাভাস্কার, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, দিলিপ ভেঙ্গসরকার, মহিন্দর অমরনাথ, যশপাল শর্মা, সন্দিপ পাতিল, কপিল দেব ও রবি শাস্ত্রির মত মেধাবি ও উঁচু মানের ক্রিকেটারদের পদচারণা ছিল। দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তির একটা ভারসাম্যও ছিল তখন।
এরপর আজহারউদ্দিন, শচিন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভি এস লক্ষ্মণ, জাভাগাল শ্রীনাথ, মানিন্দার সিং, অনিল কুম্বলেরা ভারতীয় ক্রিকেটকে করেছেন আরও সমৃদ্ধ ও উন্নত। একই ভাবে সাঈদ আনোয়ার, আমির সোহেল, ইজাজ আহমেদ, সেলিম মালিক, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, মোহাম্মদ ইউসুফ, রশিদ লতিফ, আকিব জাভেদ, ইনজামাম উল হক, মোশতাক আহমেদ, সাকলায়েন মোশতাকরাও পাকিস্তান ক্রিকেটের অগ্রযাত্রা রেখেছেন বহাল।
তখন দু’দেশের লড়াই হতো সেয়ানে সেয়ানে। এরপর বিরেন্দর শেবাগ, যুবরাজ সিং, হরভজন সিং, জহির খান ও ধোনিরা ভারতের মানকে ধরে রাখতে পারলেও শোয়েব আখতার, শহিদ আফ্রিদি, আব্দুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ ইউসুফ, ইউনিস খান ও সাঈদ আজমলদের অধ্যায় শেষ হতেই পাকিস্তানে মেধাবি ও বিশ্বমানের ক্রিকেটারের সংখ্যা কমতে থাকে।
এর পরপরই পাকিস্তানের অবনমন শুরু। তারপর সময় যত গড়িয়েছে, ততই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে থাকে পাকিস্তান। আর আইসিসি ইভেন্টের হিসেব, সমীকরণ ও ইতিহাসেও ভারত এবং পাকিস্তান লড়াইয়ের আকর্ষণ কমিয়েছে।
পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে কখনোই ভারতের সাথে পারেনি পাকিস্তান। প্রতিবার হেরেছে। অর্থ্যাৎ ৫০ ওভারের আসরের পাকিস্তানের সাথে বিশ্বকাপে ভারতের সাফল্য শতভাগ। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে (একবার) ভারতকে হাতে গোনা ক’বার হারাতে পারলেও পাকিস্তানই হেরেছে অনেক বেশি। তাই ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে এখন ভারতের সামনে পাকিস্তান আন্ডারডগ হয়ে পড়েছে।
মোটকথা, সময়ের সাথে সাথে ভারত যতটা ওপরে উঠেছে ও যে স্ট্যান্ডার্ড ধরে রেখেছে পাকিস্তান তা পারেনি। আর এখনতো ভারতীয়রা ক্রিকেটে প্রায় বিশ্বকে শাসন করছে।
ভারতীয় দলে বিচক্ষণ, ক্রিকেট বোধবুদ্ধি সম্পন্ন, হাইপ্রোফাইল বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন যারা শুধু নামে নন বরং কাজেও বিশ্বসেরা। যদি নাম ধরে বলি- বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, জসপ্রিত বুমরাহ, সূর্যকুমার যাদব, রবিন্দ্র জাদেজা, হার্দিক পান্ডিয়াসহ আরও যারা আছেন তাদের সবাইকে নিয়ে ভারত একটা পরিপূর্ণ ব্যালেন্সড দল।
সেখানে বাবর আজম, ফাখর জামান, মোহাম্মদ রিজওয়ান, শাদাব খান, শাহিন শাহ আফ্রিদি, মোহাম্মদ আমির, হারিস রউফের পাকিস্তান অনেকটাই পিছিয়ে। পুরো দলটা বাবর আজম নির্ভর। যেদিন বাবর তার নিজের সেরাটা খেলতে পারেন সেদিনই পাকিস্তান জয় লাভ করে।
পাকিস্তানের পেস বোলিং নিয়েও অনেক কথা হয়। শাহিন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহ, হারিস রউফ আর নতুন করে ফেরা মোহাম্মদ আমিরকে নিয়েও কেউ কেউ বড় মন্তব্য করেন; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচে দেখা গেছে পাকিস্তানী ফাস্ট বোলাররা এখন ‘কাগুজে বাঘ।’
আমিরের বোলিং দেখে মনে হলো, সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে মোহাম্মদ আমির একাই ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ ধসে দিয়েছিলেন। তার প্রথম স্পেলে ভারতীয় টপ অর্ডার দাঁড়াতেই পারেনি। এককথায় সেদিন যে মোহাম্মদ আমিরের কোন বল ভারতীয় ব্যাটাররা বুঝতেই পারেনি তা অতিবড় ভারতীয় সমর্থকও স্বীকার করবেন।
অথচ এই আমিরকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাটারদের কাছে যথারীতি মার খেয়ে নিজ দলকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছেন। এছাড়া বাকিরাও সেই ম্যাচে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি।
অর্থাৎ পাকিস্তানের পেস বোলিংয়ের বর্তমান ফর্ম আগের মতো নেই। খুব ফিকে হয়ে গেছে। যা ভারতের ব্যাটিং লাইনআপের সামনে দাঁড়ানোর মতো নয়। অন্যদিকে আর্শদিপ সিং, হার্দিক পান্ডিয়া, জসপ্রিত বুমরা আর সিরাজরা অনেক নিয়ন্ত্রীত ও সুশৃঙ্খল। তাদের হাত থেকে আলগা ডেলিভারি যায় খুব কম। তারা কেউই অযথা গতি সঞ্চার করতে গিয়ে বলগাহীন বোলিং করেন না।
তাই ভারতের পেস বোলারদের কার্যকরিতা সাম্প্রতিক সময় ও কয়েক বছর ধরেই বেশি। এসব কারণেই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচকে বর্তমান সময়ে আর ‘মহারণ’ বলা যায় না। পাকিস্তান এখন আসলে ভারতকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত দলই নয়। এ দু’দলের লড়াইটা এখন হয়ে গেছে একপেশে।
একপেশে লড়াইকে কি আর হাই ভোল্টেজ ম্যাচ বা ‘মহারণ’ বলা যায়?
এআরবি/আইএইচএস