ভারতে জন্ম দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে বাংলাদেশি মা

2 hours ago 2

‘মা মুঝে কুচ খানে কো দো! মুঝে ভুখ লাগা। মাইনে সুবাহ সে কুচ নেহি খায়া, কম সে কম মুঝে কুচ খানা কো তো দো!’ পেটের ক্ষুধায় মায়ের কাছে খাবার চেয়ে এভাবেই আর্তি প্রকাশ করছিল ছোট্ট শিশু নুরানী আফসানা। ঢাকার রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ যদি কোনো শিশুর কণ্ঠের এমন হিন্দি ভাষা কানে ভেসে আসে যে কোনো পথিকই হয়তো একটু থমকে দাঁড়াবেন। হয়তো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চাইবেন, কে এই শিশু? কৌতূহলী কেউ হয়তো জানতেও চাইবেন কী তার জন্মপরিচয়? কোথায় তার দেশ?

রাজধানীর জিয়া উদ্যানে (চন্দ্রিমা উদ্যান) এমনই একটি পরিবারের দেখা মিলেছে। পিতৃহীন দুই শিশুসন্তান নিয়ে যে পরিবারটির জন্য লড়ছেন নাদিরা বেগম নামের এক নারী। চাইলেই তিনি সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছেন না। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে পারছেন না। জীবন তাদের ভাসমান, ভবিষ্যৎ তাদের অনিশ্চিত। সম্প্রতি জিয়া উদ্যানের মসজিদের সামনে বসে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এমনই এক রূঢ় অথচ বাস্তব জীবনের গল্প শোনাচ্ছিলেন নাদিরা বেগম।

শৈশবেই বাবা-মাকে হারান নাদিরা। এসময় বেঁচে থাকার তাগিদে নরসিংদী থেকে পাড়ি জমান ঢাকায়। এরপর জীবন তাকে টেনে নিয়ে যায় ঢাকা থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের মুম্বাই পর্যন্ত

ঠিক কিছুক্ষণ আগেই নাদিরার কাছে খাবার চেয়ে কাঁদছিল তার সাত বছর বয়সী সন্তান নুরানী আফসানা। পাশেই বসা ছিল আরেক সন্তান ফরহাদ আজমীর। তার বয়স এখন নয় বছর। জীবনের কথা বলতে গিয়ে শুরুতেই নাদিরা ফিরে যান দেড় যুগ আগে। জীবন থেকে ঝরে যাওয়া দীর্ঘ এই সময় তাকে শুধু হাহাকার আর অনিশ্চয়তাই দিয়েছে। যেটুকু পেয়েছেন তার চেয়েও যেন বেশি হারিয়েছেন।

ভারতে জন্ম দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে বাংলাদেশি মা

নাদিরার জীবনযুদ্ধের শুরুটা নরসিংদীর ঘোড়াশালে। তালেব আলী ঘরামী ও মাইদা বেগম দম্পতির এই সন্তান শৈশবেই বাবা-মাকে হারান। এসময় বেঁচে থাকার তাগিদে নরসিংদী থেকে পাড়ি জমান ঢাকায়। এরপর জীবন তাকে টেনে নিয়ে যায় ঢাকা থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের মুম্বাই পর্যন্ত।

দাদারের সেই দিনগুলো কঠিন হলেও খেয়েপরে কোনোরকম চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সেখানেও সুখ সইলো না নাদিরার কপালে। হিন্দির পাশাপাশি তার বাংলা ভাষায় কথা বলার বিষয়টি একসময় টের পেয়ে যায় মহারাষ্ট্র পুলিশ

ছেলেমেয়েরা হিন্দিতে কথা বলছে—এর কারণ জানতে চাইলে নাদিরা বেগম বলেন, ‘আমার শিশু সন্তানের জন্ম ভারতের মুম্বাইয়ে। তারা মুম্বাই শহরে বড় হয়েছে।’

আরও পড়ুন
ভারত থেকে পুশ ইন ঠেকানো সম্ভব নয়: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
ভারতীয় নাগরিক ও রোহিঙ্গাদেরও ঠেলে দিচ্ছে বিএসএফ
শত শত মুসলিমকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে ভারত

৩৮ বছর বয়সী এই নারী জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় ধরে লড়ছেন। এখন আর চোখে কূলকিনারা দেখছেন না। কথা বলতে বলতে নাদিরা জানান, বাবা-মাকে হারানোর পর ঢাকায় এসে অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ নেন। কাজ করতে গিয়ে অপরিচিত এক নারীর সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। সেই নারী ভালো কাজ দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে তাকে নিয়ে যায় ভারতের দিল্লিতে।

বাঙালি বলে পুলিশ আমাকে জেলে দেয়। ছয় মাস জেলে ছিলাম। এরপর আমাকে মুম্বাই থেকে এনে আসাম বর্ডারে ছাইড়ে দিছে। ছেলেমেয়ের জন্মসনদ ওরা কাইড়ে নিছে। বাংলাদেশের কোনো পরিচয়পত্রও নাই।—নাদিরা বেগম

দিল্লি থেকে একসময় উত্তরপ্রদেশের রাজধানী কানপুরে চলে যান নাদিরা। কানপুরের বাসিন্দা সেলিম শাহর সঙ্গে বিয়ে হয় তার। পরে এ দম্পতি কানপুর থেকে পাড়ি জমান মুম্বাই শহরের দাদার এলাকায়। সেখানেই তাদের ঘর আলো করে ফরহাদ আজমী ও নুরানী আফসানার জন্ম।

দেশ ছেড়ে গেলেও স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে সংসার বেশ ভালোই চলছিল নাদিরার। কিন্তু হঠাৎই তার জীবনে আসে কালবৈশাখী ঝড়। ২০২১ সালে মহামারি করোনাভাইরাস স্বামীকে কেড়ে নেয় নাদিরার জীবন থেকে। স্বামী মাদকাসক্ত থাকলেও ছিলেন পরিবারের খুঁটি। তাকে হারানোর পর সন্তানদের নিয়ে অথৈ অন্ধকারে পড়েন নাদিরা। শুরু হয় অন্য এক অধ্যায়।

ভারত সরকার তাড়িয়ে দিল। আমার কোনো পরিচয়পত্র নেই। বাংলাদেশ সরকার আবার রাতের আঁধারে কোনো এক বর্ডারে আমাকে ও আমার সন্তানদের ফেলে দেবে না তো!—নাদিরা বেগম

স্বামীহীন সংসারে জীবিকার তাগিদে পথে নামেন নাদিরা। মুম্বাই শহরের দাদারে ফুটপাতে ফেরি করে মালামাল বিক্রি করতেন সেলিম শাহ। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজেই সেই ব্যবসার হাল ধরেন। কানের দুল, বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করতেন। ছেলেমেয়েকেও একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। নিজে হিন্দি ও বাংলা দুই ভাষায়ই কথা বলতে পারেন। তবে সন্তানদের মতো অনর্গল হিন্দি বলতে পারেন না। দীর্ঘদিন ভারতে থাকার কারণে এখন বাংলা ভাষায়ও ততটা সাবলীল নন নাদিরা।

দাদারের সেই দিনগুলো কঠিন হলেও খেয়েপরে কোনোরকম চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সেখানেও সুখ সইলো না নাদিরার কপালে। হিন্দির পাশাপাশি তার বাংলা ভাষায় কথা বলার বিষয়টি একসময় টের পেয়ে যায় মহারাষ্ট্র পুলিশ।

ভারতে জন্ম দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে বাংলাদেশি মা

তার কাছে আধার কার্ড ও প্যান কার্ড দেখতে চায় পুলিশ। তিনি এসব ডকুমেন্ট দেখাতে পারেননি। জিজ্ঞাসা করা হয় ধর্মীয় পরিচয়। মুসলিম জানার পর তার ওপর অবিশ্বাস বাড়ে পুলিশের। তাকে গ্রেফতার করে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফাডনবিশ সরকার। ছয় মাস জেলখানায় রাখা হয় তাকে। পরে মুম্বাই থেকে আনা হয় বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা আসাম প্রদেশে।

গত ৮ আগস্ট দুই শিশুসন্তানসহ নাদিরাকে ছেড়ে দেওয়া হয় আসামের পাহাড়ের পাদদেশে। পরে সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবি সদস্যরা হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে নাদিরাকে পাঠিয়ে দেন নরসিংদী। তবে দীর্ঘ ১৭ বছর পর নিজ গ্রামে ফিরেও আপনজন বলতে কাউকে পাননি।

জীবন তাকে আবার টেনে আনে বহু বছর আগে ছেড়ে যাওয়া এই ঢাকা শহরে। নাদিরা জানান, দুই সন্তান নিয়ে এখন ফার্মগেটে সড়কের পাশে ফুটপাতে রাতযাপন করেন। সারাদিন জিয়া উদ্যানে ঘুরে ঘুরে পানি বিক্রি করে যে কয় টাকা রোজগার হয় তা দিয়েই কোনোরকম বেঁচে আছেন।

তবে অজানা এক শঙ্কা এখনো পিছু ছাড়েনি নাদিরার। বাংলাদেশে জন্ম হলেও তার নিজের কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। সন্তানদের জন্মসনদ ছিল, তা কেড়ে নিয়েছে ভারত সরকার। এখন দুই সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন, কোথায় একটু নিরাপদ জীবনের সন্ধান পাবেন, তা জানা নেই তার। বরং নতুন করে আইনি জটিলতায় পড়ার ভয় সবসময় তাড়া করে তাকে।

ভারতে জন্ম দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে বাংলাদেশি মা

নাদিরা বলেন, ‘ভালো কাম দেবে বলে আমাকে যশোর সীমান্ত দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়। সেখানে এক ব্যাটার লগে বিয়ে হয়। স্বামী করোনায় মারা যায়। দাদার শহরে বাচ্চাদের খেলনা ও কানের দুল বিক্রি করতাম। ভালোই চলছিল। কিন্তু বাঙালি বলে পুলিশ আমাকে জেলে দেয়। ছয় মাস জেলে ছিলাম। এরপর আমাকে মুম্বাই থেকে এনে আসাম বর্ডারে ছাইড়ে দিছে। ছেলেমেয়ের জন্মসনদ ওরা কাইড়ে নিছে। বাংলাদেশের কোনো পরিচয়পত্রও নাই।’

আরও পড়ুন
পুশইন কমে আসছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
‘অবৈধ ভারতীয়দের’ পুশ ব্যাক শুরু করেছে বাংলাদেশ

কাঁটাতারের পৃথিবীতে দেশ থেকেও এখন দেশ নেই নাদিরার সন্তানদের। নিজ দেশে নাদিরা নিজেও পরিচয়হীন। স্বার্থের পৃথিবীতে তাদের নেই একটুখানি আশ্রয় কিংবা আত্মপরিচয়। মাটিতে জায়গা নেই, মাথার ওপর ছায়া নেই। ছেলেমেয়ের দেশের নাম কী, পরিচয় কী, ভবিষ্যৎ কী—এসব প্রশ্নের উত্তরও জানা নেই নাদিরার।

এক কাপড়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছেন। যেদিন পানি বিক্রি কম হয় সেদিন অনাহার বা অর্ধাহারে থাকতে হয়। ভারতে জন্ম সন্তানদের মতো নিজেরও পরিচয় নেই। বাংলাদেশ সরকারও কোনো একদিন তাদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেবে না তো—নাদিরার মনের ভেতর এ প্রশ্ন ঘুরপাক খায় বারবার।

‘আমার জীবনে অনেক কষ্ট ভাই। দুই বেলা নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাওয়াতে হয়। আমি খাওয়ার কষ্ট সইতে পারি, মাসুম বাচ্চারা তো সেটা পারবে না। ভারত সরকার তাড়িয়ে দিল। আমার কোনো পরিচয়পত্র নেই। বাংলাদেশ সরকার আবার রাতের আঁধারে কোনো এক বর্ডারে আমাকে ও আমার সন্তানদের ফেলে দেবে না তো’—বিস্ময়ভরা চোখে বলেন নাদিরা বেগম।

এমওএস/এমকেআর/এমএফএ/জিকেএস

Read Entire Article