ব্যবসার জগতে পণ্য, মূলধন, প্রযুক্তি কিংবা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি—সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর সবকিছুর পেছনে যাঁরা কাজ করেন, সেই মানুষগুলোই সবচেয়ে বড় সম্পদ। একটি দক্ষ, দায়িত্ববান ও কৌশলগতভাবে সাজানো টিম না থাকলে, বড় স্বপ্নের ব্যবসাও খুব দ্রুতই ভেঙে পড়ে। অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসার শুরুতে একক প্রচেষ্টায় কিছুটা সফল হলেও, পরবর্তীতে একটি শক্তিশালী টিম গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই তাদের ব্যবসা থমকে যায় বা ধ্বংস হয়ে যায়।
বিশ্বখ্যাত উদ্যোক্তা স্টিভ জবস বলেছিলেন, “Great things in business are never done by one person. They're done by a team of people.” এই একটি বাক্যই বোঝায় যে, ব্যক্তিগত দক্ষতা যতই উচ্চমানের হোক না কেন, সফলতা আসে যৌথ প্রচেষ্টা থেকে। উদ্যোক্তারা যখন শুধুমাত্র নিজেকে কেন্দ্র করে সবকিছু পরিচালনা করতে চান, তখনই সমস্যার শুরু হয়। ব্যবসা বড় হতে গেলে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি টিম, নেতৃত্ব বিকাশ, সমন্বয় এবং কাজের সংস্কৃতি গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের ব্যবসায়িক বাস্তবতায় দেখা যায়, বেশিরভাগ উদ্যোক্তা শুরুতে বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিতজনদের নিয়ে টিম গড়ে তোলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের অভিজ্ঞতা, পেশাদারিত্ব ও উদ্দেশ্য ভিন্ন হওয়ায় টিমে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ঢাকার মিরপুর এলাকার এক সফল রেস্তোরাঁ উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আমি শুরুর দিকে আমার স্কুল বন্ধুদের নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু কিছুদিন পর তারা কেউ দায়িত্ব নিত না, কেউবা টাকা নিয়ে হিসেব দিত না। আমি একাই সব সামলাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। শেষে পুরো টিমই ভেঙে যায়।”
এমন অভিজ্ঞতা বহু উদ্যোক্তার আছে। বাংলাদেশ SME ফাউন্ডেশনের ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ৫ বছরে ব্যর্থ হওয়া ১০০টি ব্যবসার মধ্যে ৬৫টি প্রতিষ্ঠানে 'দুর্বল টিম' ও 'অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব' প্রধান কারণ ছিল। দক্ষ লোক নিয়োগ, টিম ম্যানেজমেন্ট, দায়িত্ব বন্টন ও নেতৃত্ব বিকাশে উদ্যোক্তারা সঠিক প্রস্তুতি না নেওয়ার কারণেই এই ধরনের ব্যর্থতা ঘটে।
একটি ভালো টিম মানে শুধু কিছু দক্ষ কর্মী নয়—বরং এমন একটি পরিবেশ যেখানে সবাই পারস্পরিক শ্রদ্ধা, দায়িত্ব, স্বচ্ছতা এবং একসাথে লক্ষ্যপূরণে বিশ্বাস করে। অনেক সময় দেখা যায়, উদ্যোক্তা টিম মেম্বারদের শুধু 'কাজের লোক' হিসেবে দেখেন, অথচ তারা নিজের ব্যবসায় যতটা মমতা দেখান, টিমকে সেই গুরুত্ব দেন না। এতে টিমের মধ্যে কাজের আগ্রহ, আস্থা এবং মালিকানার বোধ হারিয়ে যায়।
এখানে আমরা দেখতে পাই, দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম বাবুল কীভাবে একজন টিম বিল্ডার ছিলেন। তিনি শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়েই ব্যবসা চালাননি; বরং সেরা এক্সপার্টদের নিয়োগ করে দায়িত্ব দিয়েছেন। যমুনা ফিউচার পার্ক বা যমুনা ইলেকট্রনিক্সের মতো বড় প্রকল্পগুলো পরিচালনার পেছনে ছিল একাধিক দক্ষ ব্যবস্থাপকের সমন্বিত প্রচেষ্টা। প্রতিষ্ঠানের আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে তার অন্যতম কৌশল ছিল ‘লং-টার্ম লয়াল লিডারশিপ টিম’ গঠন করা।
একজন উদ্যোক্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, টিমের প্রতিটি সদস্যের দক্ষতা ও স্বভাব বুঝে কাজ বণ্টন করা। কেবল আত্মীয় হওয়ার কারণে কাউকে মার্কেটিং হেড বানিয়ে দিলে বা পারিশ্রমিক ঠিক না করেই অস্থায়ীভাবে লোক রাখলে সমস্যা হবেই। কাজের পরিবেশে পেশাদারিত্ব না থাকলে, পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনো লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। ইউনিলিভার বাংলাদেশ-এর মতো কোম্পানি যেখানে প্রতিটি লিডারকে একাধিক প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়নের পর দায়িত্ব দেয়, সেখানে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও যদি টিম গঠনে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে ব্যবসায় সফলতা কেবল কল্পনাই থেকে যাবে।
একটি উদাহরণ টানতে পারি চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্প উদ্যোক্তা মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি শুরুতে সবকিছু নিজে করতেন—বায়ারদের সঙ্গে দেখা, প্রোডাকশন ফলোআপ, অ্যাকাউন্টস সবকিছু। কিন্তু যখন ব্যবসা বড় হলো, তখন একের পর এক সমস্যা দেখা দিল। তিনি পরে বুঝতে পারেন, নিজেকে প্রতিটি কাজে খাটিয়ে না দিয়ে প্রফেশনাল টিম তৈরি করতে হবে। তারপর থেকেই তিনি ফ্যাশন ডিজাইন, ফাইন্যান্স, মার্কেটিং ও এইচআর—এই চারটি মূল বিভাগে আলাদা টিম তৈরি করেন এবং শুধু কৌশলগত দিকগুলো নিজে দেখতেন। এখন তার ব্যবসা বছরে ৬০ কোটি টাকারও বেশি রপ্তানি করে।
গবেষণা বলছে, সফল কোম্পানিগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো—তাদের মধ্যে শক্তিশালী ‘co-founder dynamic’। অর্থাৎ, যারা একসাথে ব্যবসা শুরু করেছেন, তাদের মধ্যে ভূমিকা বিভাজন, পারস্পরিক সম্মান ও লক্ষ্য অর্জনে সমন্বয় থাকে। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে-সব স্টার্টআপে সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাদের ব্যর্থতার হার ৬২%।
এই দ্বন্দ্ব এড়াতে এবং একটি কার্যকর টিম গড়ে তুলতে যা দরকার তা হলো—একটি স্পষ্ট ভিশন, দায়িত্ব বণ্টনের লিখিত চুক্তি, টিম মেম্বারদের সঙ্গে খোলামেলা কমিউনিকেশন এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর পারফরমেন্স মূল্যায়ন। অনেক উদ্যোক্তা মনে করেন, তাদের ব্যবসায় চুক্তির দরকার নেই, এটা ‘বন্ধুত্ব বা বিশ্বাসের ব্যাপার’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, টিম গঠন ও পরিচালনায় পেশাদারিত্ব না আনলে, সেই বিশ্বাস দ্রুতই ভেঙে পড়ে।
সবশেষে বলা যায়, ব্যবসা বড় করতে চাইলে টিমকে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসা মানেই শুধু লাভ নয়, এটি একটি সম্পর্কের জাল, যেখানে কর্মী, ম্যানেজার ও উদ্যোক্তা একসঙ্গে স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটে। উদ্যোক্তা যদি সবার ওপর আস্থা রাখেন, সবার দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করেন এবং একটি সহানুভূতিশীল ও স্বচ্ছ কাজের পরিবেশ গড়ে তোলেন—তাহলে সেই ব্যবসা শুধু টিকেই থাকবে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য এক শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলবে।
লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট ও আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না” বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
এইচআর/এমএস