যমুনা নদীর ওপর নবনির্মিত রেলসেতু দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজ ১৯ মার্চ বুধবার থেকে ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ সেতু দিয়ে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রেনের আসনের শ্রেণি অনুযায়ী ভাড়া বেড়েছে ৪৫ থেকে ১৪৫ টাকা পর্যন্ত। নবনির্মিত রেল সেতু দিয়ে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি রেলের নিয়মানুযায়ী বাস্তবায়ন করা হলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা।
যাত্রীরা জানান, এতদিন যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বহুমুখী যমুনা সড়ক সেতুর একপ্রান্তে রেল লাইন সংযোগ করে ট্রেন চলাচল করতো। এবার রেলওয়ের নিজস্ব সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। এটি রেলওয়ের জন্য গর্বের ও সম্মানের। পাশাপাশি যাত্রী হিসেবে আমরাও আনন্দিত ও গর্বিত। কিন্তু নবনির্মিত রেল সেতু দিয়ে ট্রেন পারাপারে যাত্রীদের ভাড়া বাড়ানোর কথা শুনে বিস্মিত হয়েছি। বিগত কয়েক বছরে দফায় দফায় ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। ইতঃপূর্বে ট্রেন সেতু দিয়ে চলাচল করেছে। এখন আরও নতুন ও আধুনিক সেতু দিয়ে ট্রেন চলছে। এতে ভাড়া বাড়ানোর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। ভাড়া বাড়ানোর ফলে যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়বে। পাশাপাশি রেলওয়ে যে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তা থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা সংকট দেখা দেবে।
ঈশ্বরদী থেকে ঢাকাগামী চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী রফিকুল ইসলাম লিটন জাগো নিউকে জানান, ১৯ মার্চ থেকে যমুনা সেতুতে চলাচলকারী ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে এটি ট্রেন যাত্রীদের জন্য ‘মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’। আগেও সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল করেছে। এখনও সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলছে। নতুন করে ভাড়া বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। এখন এমনিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। এ অবস্থায় নিঃসন্দেহে ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে।
- আরও পড়ুন-
- যমুনা রেলসেতু: উদ্বোধন হলেও থেকে গেলো পথের কাঁটা
- যে কারণে বাড়লো যমুনা রেলসেতুতে চলাচলকারী ট্রেনের ভাড়া
- গন্তব্যে পৌঁছাতে ট্রেনযাত্রায় সময় লাগছে কম
আরেক ট্রেন যাত্রী জহুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, যমুনা রেল সেতুর কারণে ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি হবে এটি শুনেছি। আমরা সবাই জানি রেলওয়ে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর আগে যমুনা বহুমুখী সেতু (সড়ক বিভাগের সেতু) দিয়ে ট্রেন চলাচল করেছে। এখন রেলওয়ে নিজস্ব সেতু নির্মিত হয়েছে। এখন নিজস্ব সেতু দিয়ে ট্রেন চলবে তাহলে কেন ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। এখন যদি হঠাৎ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয় তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য তা অত্যন্ত কষ্টকর হবে। তাছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষ যারা স্বল্প খরচে স্বাচ্ছন্দ্যে ট্রেনে যাতায়াত করতো বিকল্প উপায়ে যাতায়াতের পথ খুঁজবে।
১৯ মার্চ চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনে ঈশ্বরদী থেকে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে যাবেন আব্দুর রহমান নামে এক ট্রেন যাত্রী। তিনি এ ট্রেনের শোভন চেয়ারে টিকেট সংগ্রহ করেছেন ৩৯০ টাকায়। গত সপ্তাহে তিনি এ ট্রেনে ঢাকা গিয়েছিলেন ৩৪০ টাকায়। এবার তাকে রেল সেতুর কারণে ৫০ টাকা বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। যদিও ভাড়া ৪৫ টাকা বেড়েছে কিন্তু ৫ টাকা খুচরা সংকটের কারণে ভাড়া ৩৮৫ টাকা নির্ধারণ না করে ৩৯০ টাকা করা হয়েছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগেও সেতু হয়ে ট্রেন ঢাকায় যেতো। এখনো সেতু হয়েই যাবে। তবে কেন জনপ্রতি ৫০ টাকা ভাড়া বাড়ানো হলো। এটি আসলে মেনে নেওয়া যায় না। আর কাকে কী বলবো, বলেই বা কী লাভ হবে।
পাকশী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৮ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে নবনির্মিত এ সেতুর উদ্বোধনের পর প্রতিদিন ১৫ জোড়া আন্তঃনগর ও ১ জোড়া মেইল ট্রেন চলাচল করছে। ১৯ মার্চ এ সেতু দিয়ে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রেনের আসনের শ্রেণি অনুযায়ী ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৪৫ থেকে ১৪৫ টাকা পর্যন্ত। রেল সেতুর সমন্বিত দূরত্বের নিয়ম অনুযায়ী এই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা। এছাড়াও আগের যমুনা বহুমুখী সেতু ওপর দিয়ে ট্রেন পাড়ি দিতে সময় লাগতো ২০ মিনিট। এখন সেতু পাড়ি দিতে সময় লাগবে সাড়ে তিন মিনিট।
আগে যমুনা সেতুর সঙ্গে যুক্ত রেল লাইনের দৈর্ঘ্য ছিল ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এই সেতুর এক কিলোমিটার সমপরিমাণ ১৬.৮০ কিলোমিটার রেল লাইন পরিমাপ করা হতো। সেইসঙ্গে এই সেতুর দুই পাশের স্টেশনের দূরত্ব ছিল ৫ কিলোমিটার করে ১০ কিলোমিটার। সবমিলিয়ে এ রেললাইনের দূরত্ব ছিল ৯১ কিলোমিটার।
নবনির্মিত রেল সেতুর দূরত্ব ৪.৮ কিলোমিটার। এ রেলসেতুর এক কিলোমিটার সমপরিমাণ ২৫ কিলোমিটার রেল লাইন নির্ধারণ করা হয়েছে। রেলসেতুর রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ হিসেবে এটি নির্ণয় করা হয়। সেইসঙ্গে এই সেতুর দুই পাশে ১০ কিলোমিটার রেললাইন স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এ রেলসেতুর সমন্বিত দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। নবনির্মিত সেতুর দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার থেকে আগের রেল সেতুর ৯১ কিলোমিটার বাদ দিলে নতুন রেল সেতুর বর্ধিত সমন্বিত দূরত্ব ৩৯ কিলোমিটার। এই বর্ধিত ৩৯ কিলোমিটার সেতুর ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) গৌতম কুমার কুন্ডু জাগো নিউজকে বলেন, রেলওয়ে নিয়মানুযায়ী নবনির্মিত যমুনা রেলসেতুর ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। যাত্রীরা বিষয়টি উপলব্ধি করবেন বলে আশা করছি।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে রাজশাহীর চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার সুজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে বলতে হলে শুধু এটুকু বলবো, রেলের নিয়ম অনুসারে বা বিধি অনুসারে যমুনা সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচলের কারণে ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। এ নিয়ম শুধু এ সেতুর ক্ষেত্রে নয় প্রতিটি ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য সেতুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রয়েছে।
রেলওয়ে নির্ধারিত নতুন বর্ধিত ভাড়ার তালিকা (ভ্যাট ব্যতীত) অনুযায়ী দেখা যায়, রাজশাহী থেকে ঢাকা রুটে চলাচলকারী বনলতা এক্সপ্রেস, সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, পদ্মা এক্সপ্রেস, ধূমকেতু এক্সপ্রেসের শোভন চেয়ারের চলমান ভাড়া ৪০৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৫০ টাকা। এতে প্রতি আসনে ৪৫ টাকা বেড়েছে। এসি চেয়ারে ভাড়া ৬৭০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫০ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ৮০ টাকা। এসি সিট ৮০৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯০০ টাকা। প্রতি আসনে বেড়েছে ৯৫ টাকা। এসি বার্থ ১২০৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩৪৫ টাকা। প্রতি আসনে বেড়েছে ১৪০ টাকা।
খুলনা-ঢাকা রুটে চলাচলকারী চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনের শোভন চেয়ারের চলমান ভাড়া ৬৩০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮০ টাকা। প্রতি আসনে বেড়েছে ৫০ টাকা। এসি চেয়ার ১০৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১৩০ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ৮০ টাকা। এসি সিট চলমান ভাড়া ১২৬০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩৫৫ টাকা। এ আসনে বর্ধিত ভাড়া ৯৫ টাকা। এসি বার্থ চলমান ১৮৮৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২০৩০ টাকা। প্রতি আসনে বেড়েছে ১৪৫ টাকা।
পঞ্চগড়-ঢাকা রুটে চলাচলকারী একতা, দ্রুতযান ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনের শোভন চেয়ারের চলমান ভাড়া ৬৯৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৮০ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ৪৫ টাকা। এসি চেয়ার চলমান ভাড়া ১১৬০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১২৩৫ টাকা। ভাড়া বেড়েছে ৭৫ টাকা। এসি সিট চলমান ভাড়া ১৩৯০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪৮০ টাকা, ভাড়া বেড়েছে ৯০ টাকা। এসি বার্থ চলমান ভাড়া ২০৮৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২২১৫ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ১৩০ টাকা।
লালমনিরহাট/রংপুর-ঢাকা রুটে চলাচলকারী লালমনি এক্সপ্রেস, বুড়িমারী এক্সপ্রেস ও রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের শোভন আসনের চলমান ভাড়া ৬৩৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮০ টাকা। প্রতি আসনে বেড়েছে ৪৫ টাকা। এসি চেয়ার চলমান ভাড়া ১০৫৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১৩০ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ৭৫ টাকা। এসি সিট চলমান ভাড়া ১২৬৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩৫৫ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ৯০ টাকা। এসি বার্থ চলমান ভাড়া ১৮৯৫ টাকা থেকে হয়েছে ২০৩০ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ১৩৫ টাকা।
চিলাহাটি-ঢাকা রুটে চলাচলকারী নীলসাগর ও চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের শোভন চেয়ারের চলমান ভাড়া ৬২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৬৫ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ৪৫ টাকা। এসি চেয়ার ভাড়া ১০৩০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১০৫ টাকা, আসন প্রতি বেড়েছে ৭৫ টাকা। এসি সিট ভাড়া ১২৩৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩২৫ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ৯০ টাকা। এসি বার্থ চলমান ভাড়া ১৮৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯৮৫ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ১৩৫ টাকা।
কুড়িগ্রাম-ঢাকা রুটে চলাচলকারী কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনের শোভন চেয়ারের ভাড়া ৬৪০ টাকা তা বেড়ে হয়েছে ৬৮৫ টাকা, ভাড়া বেড়েছে ৪৫ টাকা। এসি চেয়ার চলমান ভাড়া ১০৬৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১৪০ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ৭৫ টাকা। এসি সিট চলমান ভাড়া ১২৭৫ টাকা থেকে হয়েছে ১৩৬৫ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ৯০ টাকা। এসি বার্থ চলমান ভাড়া ১৯১০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২০৫০ টাকা, প্রতি আসনে বেড়েছে ১৪০ টাকা।
এদিকে ঈশ্বরদী-ঢাকা রুটে চলাচলকারী ঢাকা মেইল ট্রেন বেসরকারি সংস্থা পরিচালনা করে। এ ট্রেনের ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এফএ/এএসএম