আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গত এক বছর ধরে বাংলাদেশের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ নানা কারণে বাংলাদেশের পাসপোর্ট এখন বিশ্বের অন্যতম দুর্বল অবস্থানে নেমে এসেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স প্রকাশিত ২০২৫ সালের হেনলি পাসপোর্ট সূচকে বাংলাদেশ ১০৬ দেশের মধ্যে ১০০তম অবস্থানে রয়েছে, অর্থাৎ বিশ্বের সপ্তম দুর্বলতম পাসপোর্ট। বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে উত্তর কোরিয়া, এমনকি যুদ্ধপীড়িত ফিলিস্তিন রয়েছে আরও এক ধাপ ওপরে, ৯৯তম স্থানে।
বর্তমানে বাংলাদেশিরা মাত্র ৩৮টি দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার ভোগ করেন। তবে অনেক ভ্রমণকারী দাবি করছেন, তথাকথিত ভিসামুক্ত দেশগুলোতেও প্রবেশে বাড়ছে জিজ্ঞাসাবাদ, সন্দেহ ও বাধা।
ভিসা সংকট ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনিক দুর্বলতা, মানবপাচার ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এ অবনতি ঘটেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর থেকেই নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরপরই নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশজুড়ে ভিসাকেন্দ্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয় ভারত, যদিও পরে সীমিত পরিসরে চিকিৎসা ও শিক্ষার্থী ভিসা চালু করা হয়।
শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণে যেতে পর্যটকদের জন্য আগাম ‘ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন’ বা ইটিএ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে দেশটির সরকার। এদিকে ২০২৫ সালের মে থেকে সৌদি আরব বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের ওয়ার্ক ভিসা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।
ডেনমার্ক ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামও ভিসা প্রক্রিয়া কঠোর করেছে।
ভ্রমণকারীরা জানাচ্ছেন, এখন ভিসা পেতে সময় লাগছে বেশি, বাতিলের হার বেড়েছে এবং বৈধ ভিসা নিয়েও ইমিগ্রেশনে ‘অফলোড’ হওয়ার ঘটনা ঘটছে।
প্রত্যাবাসনে গভীর সংকট
সম্প্রতি বিদেশ থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর ঘটনাও পাসপোর্ট সংকট আরও বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কিরগিজস্তান ১৮০ অনিবন্ধিত বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠায়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত পাঠায় ৩০ জনকে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১৮৭ জনকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত পাঠিয়েছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইতালি, অস্ট্রিয়া, গ্রিস ও সাইপ্রাস থেকেও ৫২ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়। আগস্টে যুক্তরাজ্য ১৫ জন এবং মালয়েশিয়া ৯৮ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে।
মানবপাচার ও বিশ্বাস সংকট
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবপাচার ও অনিয়মিত অভিবাসনের প্রবণতা বাংলাদেশের পাসপোর্টের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা কমিয়ে দিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশিত ‘ট্রাফিকিং ইন পারসন্স (টিআইপি) রিপোর্ট ২০২৫’ অনুযায়ী, বৈশ্বিক মানবপাচারে বাংলাদেশ সার্বিক বিবেচনায় দ্বিতীয় স্তরে (টায়ার-২) রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে গত এক বছরে ৩,৪১০ জন মানুষ পাচারের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে যৌন পাচারের শিকার ৭৬৫ জন, জোরপূর্বক শ্রমের শিকার ২,৫৭২ জন এবং অন্যান্য ধরনের পাচারের শিকার ৭৩ জন। তবে বাংলাদেশ সরকার বলছে, গত এক বছরে ১,৪৬২ পাচারের শিকার ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা
২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৩ জুন পর্যন্ত অন্তত ১৭৯ জন মব হামলায় নিহত হয়েছেন।
গত জুলাই মাসে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আমি সম্প্রতি কয়েকটি দেশ সফর করেছি। বর্তমানে লাল পাসপোর্ট থাকার কারণে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি। তারপরও বাংলাদেশি হওয়ায় বারবার বাঁকা চোখে দেখেছে।
তিনি আরও বলেন, আমি যখন সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহার করি, তখন বাংলাদেশি দেখে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি।
একই অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, আমি স্বীকার করছি, বাংলাদেশিদের বিভিন্ন দেশে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। তবে পাসপোর্টের এ অবমূল্যায়নের জন্য শুধু বিদেশিরা নয়, বাংলাদেশিরাও তথা আমরাও দায়ী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আয়নুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের ই-পাসপোর্ট প্রযুক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক ডেটাবেসের সঙ্গে পুরোপুরি সংযুক্ত নয়। এছাড়া, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, পাশাপাশি জালিয়াতি ও ভুয়া তথ্য ব্যবহারের ঘটনাও বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের পর থেকে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এসব কারণে বহু দেশ এখন বাংলাদেশিদের প্রবেশে সতর্কতা অবলম্বন করছে।
তিনি যোগ করেন, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের কারণে একই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। ফলে ঢাকার অনেক দূতাবাস বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে। এই আঞ্চলিক প্রবণতাই পাসপোর্ট র্যাংকিংয়ের পতনের অন্যতম কারণ।
এমআইএইচএস/জেআইএম

3 hours ago
4









English (US) ·