ভুটানের উইমেন্স ন্যাশনাল লিগে নিজেদের প্রথম ম্যাচে পারো এফসির ২৮-০ ব্যবধানের জয়ে বাংলাদেশের সাবিনা খাতুনের গোল ছিল ৯টি। সাবিনা খাতুনকে জর্ডান সফরের দলে না রাখার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পারো এফসির ওই ম্যাচটি সামনে এনে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের ইংলিশ কোচ পিটার বাটলার ভুটানের লিগের মান নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।
শুধু প্রশ্নই তোলেননি পিটার বাটলার, ভুটানের লিগ নিয়ে রসিকতাও করেছেন তিনি। নারী ফুটবল দল নিয়ে জর্ডান যাওয়ার আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারপার্সন মাহফুজা আক্তার কিরণকে দেখিয়ে পিটার মন্তব্য করেছেন, ‘ভুটানের নারী ফুটবল লিগ কোনো লিগের মধ্যেই পড়ে না। ওই লিগে মিস কিরণও সেন্টার পজিশনে খেলার যোগ্যতা রাখেন।’
বাংলাদেশ কোচ যোগ করেন, ‘আমার কাছে ভুটানের লিগটা হেঁটে হেঁটে খেলার মতো ব্যাপার। ২৮-০ গোলে জেতা ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখে কি আমি একজন খেলোয়াড় বিবেচনা করতে পারি? অবশ্যই না।’ তারপর তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, সাবিনার সময় শেষ হয়ে আসছে।’
ভুটানের লিগে খেলা ১০ ফুটবলারের মধ্যে বাটলার পাঁচজনকে ডেকেছিলেন জর্ডান সফরের ক্যাম্পে। সাবিনাসহ ৫ জনকে বিবেচনায় রাখেননি। এমনকি তাদের ক্যাম্পে ডেকে ফিটনেস ও পারফরম্যান্স পরখ করে দেখাও প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি নারী ফুটবল দলের বিতর্কিত এই কোচ।
এটা ঠিক, একজন কোচ যাকে ভালো মনে করবেন তাকেই নেবেন। এখানে অন্যদের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। দেশের নারী ফুটবলের কিংবদন্তি সাবিনা খাতুন ফুরিয়ে গেছেন সেটা মনে করতেই পারেন কোচ। তাই বলে আরেকটি দেশের লিগ নিয়ে এমন বাজে মন্তব্য করা কতটা শোভনীয় ছিল বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের?
২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশে আছেন বাটলার। শুরুতে ছিলেন বাফুফের এলিট একাডেমির প্রধান কোচ। গত বছর থেকে নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ। বাংলাদেশের নারী ফুটবল লিগ কেমন হয় সেটা তার অজানা থাকা কথা নয়।
পিটার যে দেশের নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ সেই বাংলাদেশে লিগটা কোন মানের হয়? ভুটানের লিগে এক ম্যাচে ২৮ গোল হওয়ায় তিনি নাক সিটকিয়েছেন। তিনি কি জানেন বাংলাদেশের নারী ফুটবল লিগেও ২০-২৫ টি করে গোল হয়?
ভুটানের নারী ফুটবল লিগ যদি হেঁটে হেঁটে খেলার মতো মনে করেন তাহলে বাংলাদেশের নারী লিগও সেরকমই। প্রতি বছর দল কুড়িয়ে এনে নারী লিগ চলে বাংলাদেশে। যে দলগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই। প্যাড সর্বস্ব দল নিয়ে লিগ আয়োজন করে রুটিন কাজ সারে বাফুফে। বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সেই লিগ দেখেও ভুটানের লিগকে অফিসিয়ালি নিম্নমানের বলেছেন বাংলাদেশের কোচ।
পিটার বাটলার কি জানেন বাংলাদেশে সর্বশেষ নারী লিগে গড়ে প্রতি ম্যাচে প্রায় ৭ টি করে গোল হয়েছে? ৮ ম্যাচে নাসরিন স্পোর্টস একাডেমি করেছে ৬৩ গোল! দলটির ১৭-০ গোলের জয়ও আছে। পিটার বাটলার কি জানেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল লিগে খেলা জামালপুর কাচারিপাড়া একাদশ, সদ্যপুস্করণী যুব স্পোর্টিং ক্লাব, সিরাজ স্মৃতি সংসদ, কাঁচিঝুলি স্পোটিং ক্লাব কোন মানের দল?
তিনি কি খোঁজ নিয়েছেন ২০১৯-২০ মৌসুমে বসুন্ধরা কিংস লিগে ১২ ম্যাচে ১১৯ গোল দিয়ে কোনো গোলই খায়নি? ওই লিগেই ১২ ম্যাচ খেলে ৬৩ গোল খেয়েছিল কুমিল্লা ইউনাইটেড? ১৪-০, ১৯-০ ও ২০-০ গোলের ব্যবধানে জয় ছিল কিংসের? ২০২১-২২ মৌসুমে ১১ ম্যাচে মাত্র ২ গোল করেছিল ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব, সেখানে বসুন্ধরা কিংসের মেয়েরা করেছিল ১০০ গোল। এই লিগ কেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল মনে করছেন পিটার বাটলার? এগুলো বিশ্বসেরা বাংলাদেশ নারী লিগের কিছু উদাহরণ!
পিটার বাটলার কি ভুটানের রয়েল থিম্পু কলেজ উইমেন্স ফুটবল ক্লাবের নাম শুনেছেন? শোনার তো কথা। কারণ ভুটানের উইমেন্স ন্যাশনাল লিগের এই ক্লাবটি এএফসি নারী চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রথম আসরে খেলেছে। বাংলাদেশের চার নারী ফুটবলার কিন্তু ওই দলে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলতে। এখানে আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখা ভালো যে, ভুটানের এই লিগে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, হংকং ও যুক্তরাষ্ট্রের নারীরাও খেলেন। ৬ মাসব্যাপী চলা লিগটিতে ৬ জন বিদেশী ফুটবলার খেলানোর কোটাও আছে।
বাংলাদেশের নারী লিগের কোনো দল কি এএফসির প্রতিযোগিতায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে আগে? বলতে পারবেন পিটার? যে দেশের লিগের ক্লাব এএফসি নারী চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলে সেই লিগ নিয়ে নাক সিটকান বাংলাদেশের কোচ। অথচ তার মেয়েদের নারী লিগ যে পুরোপুরি সার্কাস, তা খেয়াল নেই পিটারের।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারপার্সন মাহফুজা আক্তার কিরণকে পাশে বসিয়েই আরেক দেশের লিগ নিয়ে এমন আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন পিটার বাটলার। কিরণ যদি ভুটানের লিগে খেলার যোগ্যতাই রাখেন তাহলে সাবিনা-কৃষ্ণাদের বদলে কিরণকে পাঠানোই তো শ্রেয় ছিল।
ভুটানের নারী লিগে খেলছেন সাবিনা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত
আসলে সাবিনাকে না নেওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাটলার ভুটানের লিগ নিয়ে আজে-বাজে কথা বলেছেন। যে লিগ খেলার কারণে সাবিনা, কৃষ্ণা, মাসুরা, সানজিদারা পিটারের চোখে অযোগ্য, একই সময়ে সেই লিগে খেলা মনিকা, মারিয়া, ঋতুপর্ণা চাকমা, রূপনা চাকমা, শামসুন্নাহাররা তাহলে যোগ্য!
শেষ পাঁচজনের যোগ্যতা নিয়ে কারো প্রশ্ন নেই। তারা দেশের অন্যতম সেরা পারফরমার। যেমন সেরা পারফরমার সাবিনা-মাসুরাও। পর পর দুটি সাফ জয়ের কারিগর তারা। আসলে ‘যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’র মতোই ঘটনা। পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ১৮ নারী ফুটবলারকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবিনা-মাসুরারা। কৌশলে সেই ‘বিদ্রোহী জোট’ ভেঙে দিয়েছেন এই ইংলিশম্যান।
আরআই/এমএইচ/এমএস