ভুট্টার হাইব্রিড বীজ এখন দেশেই উৎপাদন

3 hours ago 4

ড. ফোরকান আলী

দেশে প্রতি বছর ভুট্টার চাহিদা বাড়ছে। বেড়েছে উৎপাদনও। গত ছয় বছরে পণ্যটির উৎপাদন প্রায় ৪৬ দশমিক ৫০ শতাংশ বা প্রায় দেড়গুণ। এর বিপরীতে বিদেশ থেকে ভুট্টা আমদানি কমেছে তিন গুণ বা সাড়ে ৬৫ শতাংশ। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্য ফসলের তুলনায় বেশি লাভ ও আবাদ পদ্ধতি সহজ হওয়ায় কৃষকেরা দিন দিন ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যানুসারে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়, ফলন পাওয়া যায় প্রায় ৪৭ লাখ টন। ছয় বছর পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভুট্টা উৎপাদন বেড়ে ৬৮ লাখ ৮৪ হাজার টন ছাড়িয়ে যায়। এ সময়ে আবাদি জমির পরিমাণ ২৬ শতাংশ বেড়ে হয় ৬ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। খাতসংশ্লিষ্টরা আরও জানান, দেশে ভুট্টার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। বর্তমানে চাহিদার বেশিরভাগই স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে; বাকি অংশ আমদানি করা হয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ১৩ লাখ ২৩ হাজার টন ভুট্টা আমদানি হয়েছিল। যা সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে ৪ লাখ ৫৬ হাজার টনে নেমে এসেছে। দেশে ফলন বাড়ায় ভুট্টা আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্রপস উইংয়ের তথ্যমতে, গমের মতো ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে লাভ বেশি হয়। এতে কম পরিচর্যা লাগে। যে কোনো উঁচু জায়গায় চাষ করা যায়। ফলন বেশি হয় এবং মাড়াই প্রক্রিয়াও বেশ সহজ। এ ছাড়া একই জমিতে সাথি ফসলও চাষ করা যায়। মূলত এসব সুবিধার কারণেই কৃষকেরা ভুট্টা চাষে এখন বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাপ, খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু গম ও ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এ যাবৎ ভুট্টার ২৯টি নতুন জাত (২০টি হাইব্রিড, ৯টি কম্পোজিট) উদ্ভাবন করা হয়েছে। সারাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক শূন্য ৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার ফলন হয়েছে ৬৪ লাখ মেট্রিক টন।

বীজের চাহিদা

বর্তমানে দেশে ভুট্টার বীজের চাহিদা বাৎসরিক ১১-১২ হাজার মেট্রিক টন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর বিএডিসিকে এক টন পিতৃ-মাতৃ বীজ সরবরাহ করছে। সেখান থেকে বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ কৃষক ভিত্তিক বীজ উৎপাদন করছেন ৬০-৭০ টন। বাকি বীজ আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। অথচ ভুট্টার হাইব্রিড বীজ এখন দেশেই উৎপাদন সম্ভব। কারণ দেশে যত ভুট্টার আবাদ হচ্ছে; তার প্রায় প্রতিটি জাতই হাইব্রিড। এসব জাতের বীজ প্রায়ই বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। হাইব্রিড জাতের ভুট্টা উৎপাদন এবং হাইব্রিড বীজ উৎপাদন এক নয়। এর জন্য দক্ষ কৃষক এবং উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। তবে এখন দেশেই ভুট্টার হাইব্রিড বীজ উৎপাদন সম্ভব।

বীজ উৎপাদন কৌশল

জ্যানিটিক্যালি ভিন্ন দুই বা তারও বেশি প্যারেন্ট লাইনের ক্রসের (সংকরায়ণের) মাধ্যমে হাইব্রিড ভুট্টা পাওয়া যায়। হাইব্রিড ভুট্টার দুই বা ততধিক প্যারেন্টাল লাইনের উৎকৃষ্ট গুণাবলি একত্রিত হয়ে থাকে। তাই ভুট্টা গাছ অনেক সবল হয়। মুক্ত পরাগায়িত জাতের চেয়ে অধিক ফলন দেয় এবং গাছের উচ্চতা একই হয়।

জমি নির্বাচন

খরিপ মৌসুমে প্রধানত উঁচু জমি এবং রবি মৌসুমে মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নিচু জমি নির্বাচন করতে হবে। ভুট্টা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। যেসব জমিতে পানি নিষ্কাশনের উত্তম ব্যবস্থা আছে; সেসব জমিতে হাইব্রিড ভুট্টা বীজ উৎপাদনের জন্য নিতে হবে। জমির মাটি বেলে-দোআঁশ থেকে উর্বর দোআঁশ মাটি হলে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হয়।

জমি তৈরি

জমি চাষের আগে গোবর ও জৈব সার জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে দেওয়ার পর জো থাকা অবস্থায় ৩-৪টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হবে। জমির চারপাশে নালা করে নিতে হবে। এতে সেচ এবং অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োগ

গাছের জীবনকালের ওপর সারের ডোজ নির্ভর করে। রবি মৌসুমে উৎপাদিত গাছের জীবনকাল দীর্ঘ এবং খরিপ মৌসুমে অপেক্ষাকৃত কম। রবিতে ২৭৫-৩২৫ কেজি বা হেক্টর টিএসপি হেক্টরপ্রতি ১৬০-২০০ কেজি, এমপি ১২৫-১৫০ কেজি, জিপসাম ১৫০-১৭৫ কেজি, জিংক সালফেট ১০-১৫ কেজি, বোরন সার ৬-৮ কেজি এবং গোবর ৫০০০ কেজি, অন্য কিছু খরিপে হেক্টর প্রতি ইউরিয়া ২২০-২৭৫ কেজি, টিএসপি ১৩০-১৭০ কেজি, এমপি ১০০-১২৫ কেজি, জিপসাম ১০-১৫০ কেজি, জিংক সালফেট ৮-১২ কেজি, রোবন সার ৬-৮ কেজি এবং গোবর সার ৫০০০ কেজি।

জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া এবং অন্যান্য সার সম্পূর্ণ পরিমাণ প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ২-৩ অংশ দুইভাগ করে ৮ পাতা পর্যায়ে একবার এবং ফুল আসার আগে বাকি ডোজ দিতে হবে।

বীজ বপন পদ্ধতি

হাইব্রিড ভুট্টার বীজ উৎপাদনের জন্য রবি মৌসুম সবচেয়ে উপযুক্ত। হাইব্রিড ভুট্টার বীজ উৎপাদনে স্ত্রী ও পুরুষ লাইনের বীজ একই মাঠে পাশাপাশি সারিতে বপন করতে হয়। বপনের সময় স্ত্রী ও পুরুষ লাইনের বীজ সহজে শনাক্তকরণের জন্য দুটি ভিন্ন রঙের ব্যাগ বা ট্যাগ ব্যবহার করতে হবে।

শুধু স্ত্রী প্যারেন্ট লাইন থেকে হাইব্রিড ভুট্টার বীজ সংগ্রহ করা হয়। এ কারণে স্ত্রী ও পুরুষ প্যারেন্ট লাইনের অনুপাত হাইব্রিড বীজের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ৪:২ অনুপাতে স্ত্রী ও পুুরুষ লাইনের বীজ বপন করতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সেন্টিমিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার এবং বপনের গভীরতা ২.৫ থেকে ৩ সেন্টিমিটার। প্রতি গর্তে ১-২টি বীজ বপন করতে হবে। বপনের পর থেকে মাটির অবস্থা বিবেচনায় ৩-৪ বার সেচ দিতে হবে।

ফসল সংগ্রহ

ভুট্টার দানা সংগ্রহ করার জন্য পাকা মোচা গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। পাতা হলুদ-বাদামি হলে মোচা হাতে তুলতে হবে। হাইব্রিড ভুট্টার বীজও পুরুষ প্যারেন্ট লাইনের বীজের মিশ্রণ এড়ানোর জন্য প্রথমে পুরুষ প্যারেন্ট লাইনের বীজ সংগ্রহ করা উচিত। মোচার খোসা ছাড়িয়ে ৩-৪ দিন রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে তারপর মাড়াই করতে হবে। শুধু স্ত্রী লাইন থেকে হাইব্রিড ভুট্টার বীজ সংগ্রহ করা হয়। রবি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি গড়ে ১.৫ থেকে ২.৫ টন ভুট্টা বীজ পাওয়া যায়।

আবাদ বেশি উত্তরাঞ্চলে

দেশে ভুট্টা উৎপাদনে শীর্ষ ১০ জেলা হচ্ছে দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, রংপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, ঝিনাইদহ, জামালপুর ও গাইবান্ধা। অর্থাৎ দেশের উত্তরাঞ্চলেই ভুট্টা চাষ হয় বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে দিনাজপুর। এ জেলায় ২০২৩-২৪ মৌসুমে প্রায় ৯ লাখ ৯০ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চুয়াডাঙ্গায় ভুট্টার ফলন হয়েছে ৫ লাখ ৭৮ হাজার টন। তবে বরিশালসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে ভুট্টা উৎপাদন হয়। তবে পরিমাণ খুবই সামান্য।

উচ্চ ফলনশীল ভুট্টার জাত ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটির ভুট্টা প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার ফলন বেশি পাওয়া যায়। তাপমাত্রা বাড়লেও ভুট্টার উৎপাদনে সমস্যা হয় না। অন্যদিকে চাহিদা থাকায় গত কয়েক বছর ধরে কৃষকেরা ভুট্টার ভালো দাম পাচ্ছেন। এতে প্রতি বছর আরও বেশি জমিতে ভুট্টার আবাদ করছেন তারা।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে অনেক ভেজাল বীজ আসছে। এতে ভুট্টার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। তাই আমদানিকৃত ভেজাল বীজ বিক্রি বন্ধে ও দেশে উৎপাদিত ভুট্টার হাইব্রিড বীজে সরকারি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ।

এসইউ/জিকেএস

Read Entire Article