কিশোরগঞ্জের ভৈরবের সম্ভাবনাময় একটি খাত পাদুকা শিল্প। ভৈরবে পাদুকা সেক্টরে বছরে বেচাকেনার পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার মতো। ছোট-বড় প্রায় সাত হাজার কারখানায় কর্মরত দেড় লক্ষাধিক মানুষ। তবে অর্থায়ন ও দক্ষ কর্মীর অভাবে সংকটে রয়েছে এই শিল্প।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৮৯ সালে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যাত্রা শুরু করে পাদুকা শিল্প। সর্বপ্রথম পাদুকা কারখানা স্থাপন করা হয় ভৈরব উপজেলা পরিষদ এলাকায়। কারখানার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন আশপাশের ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়েছে। এটি এখন দেশের সবচেয়ে বড় পাদুকা শিল্প। গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় জুতার ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এ শিল্প পাল্টে দিয়েছে ভৈরবের অর্থনীতি। রাজধানী ঢাকা, বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সড়ক, নৌ ও রেলপথ যোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে। মূলত ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সস্তা শ্রমের কারণে এখানে দ্রুত প্রসার ঘটেছে পাদুকা শিল্পের। একসময় শুধু স্যান্ডেল তৈরি হলেও এখন এর পাশাপাশি লোফার, কেডসসহ বিভিন্ন ধরনের জুতা তৈরি হয়।
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তা সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানিও করা হয়। এ শিল্পকে ঘিরে অন্যান্য ব্যবসাও চাঙা হচ্ছে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ভৈরবে পাদুকা শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটছে বলে মনে করেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
ভৈরবে হাতে পাদুকা তৈরির সাত হাজার কারখানার পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ রপ্তানিমুখী বড় কারখানা রয়েছে ৪০-৫০টির মতো। এসব কারখানায় কাজ করেন দেড় লাখেরও বেশি শ্রমিক। নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। পাদুকা তৈরির কাঁচামাল, প্যাকেজিং ইত্যাদিসহ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ছয়টি বৃহত্তর পাইকারি মার্কেট এবং ৫০টিরও বেশি পাদুকা শিল্প পল্লি গড়ে উঠেছে এখানে।
পৌর শহরের ভৈরববাজার, কমলপুর, ভৈরবপুর, গাছতলাঘাট, শম্ভুপুর, জগন্নাথপুর, শিবপুর ইউনিয়নের শিবপুর, জামালপুর, ছনছাড়া, কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের কালিকাপ্রসাদ, আদর্শপাড়া, আৎকাপাড়া, আকবর নগর, মিরারচর, গজারিয়া ইউনিয়নের গজারিয়া, বাঁশগাড়ি, মানিকদী, পুরানগাঁও, শিমুলকান্দি ইউনিয়নের শিমুলকান্দি, গোছামারা, মধ্যেরচর গ্রামে প্রায় অর্ধশত পাদুকা পল্লি গড়ে উঠেছে।
পাদুকা কারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভৈরবে বিভিন্ন ধরনের স্যান্ডেল, কেডস, ফরমাল জুতা, বেল্ট, মানিব্যাগ ইত্যাদি তৈরি হয়। পণ্য উৎপাদনে চামড়া, পেস্ট, সলিউশন, রেক্সিন, ফোম, রাবার, সুতা, রং ইত্যাদি প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পণ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় সেলাই মেশিন, বব মেশিন, কালার মেশিন, কাটিং মেশিন ইত্যাদি মৌলিক যন্ত্র। বেশিরভাগ কারখানা মালিক পাইকার বা আড়তদারদের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করেন। কিছু কারখানা সরাসরি বড় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি সারাদেশ থেকে অর্ডার সংগ্রহ করে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও সরবরাহ করছে।
কারখানামালিকরা জানান, দেশের অনেক নামিদামি ও শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো জুতা প্রস্তুত ও সংগ্রহ করছে ভৈরবের কারখানা থেকে। যার মধ্যে এপেক্স, বাটা, বে, পেগাসাস, আফজালসুজ অন্যতম। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়া ও জাপানে বছরে কয়েকশ কোটি টাকার জুতা বিক্রি হচ্ছে।
ভৈরবপুর এলাকার তাহমিনা স্যান্ডেল ফ্যাক্টরির মালিক মিয়ার উদ্দিন অপু জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভৈরব বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ পাদুকা সেক্টর। তবে বর্তমানে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে। পাদুকা তৈরির বেশিরভাগ কাঁচামাল আসে চীন থেকে। ডলার বাজারের ঊর্ধ্বগতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়তই কাঁচামালের দাম বাড়ছে। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণেও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’
১০ বছর আগে ঢাকায় কারখানায় জুতা তৈরি করতেন পাদুকা ব্যবসায়ী জিয়া উদ্দিন। বর্তমানে উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় সজীব স্যান্ডেল সু ফ্যাক্টরি নামের একটি কারখানা গড়েছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রথমে ঢাকায় কারখানা করে নিজেও শ্রমিক দিয়ে জুতা তৈরি করতাম। তখনকার সময়ে তো এতো আধুনিক প্রযুক্তি আসেনি। শুধু হাতের মাধ্যমে বিভিন্ন ডিজাইনের জুতা তৈরি করতাম। এখনতো কত সহজেই কম সময়ে বাহারি ধরনের জুতা করা যায়। তবে পাদুকা শ্রমিকদের প্রযুক্তি সম্পর্কে তেমন কোনো জানাশোনা নেই। যদি শ্রমিকদের আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে টেনিংয়ের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তারা দক্ষ হয়ে উঠবে। এতে কারখানার উৎপাদন বাড়বে।’
ভৈরবপুর উত্তরপাড়ায় অবস্থিত বেইজিং পিও ফুট ফ্যাক্টরির অংশীদার সামিউল্লাহ সানি। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রথম দিকে ভৈরবে তার কারখানায় পাদুকা হাতে তৈরি হতো। এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পাদুকা তৈরি হচ্ছে। এসব কারখানায় স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে সহজে বিভিন্ন ধরনের পাদুকা তৈরি করা যায়। এতে সময় কম লাগে। তবে আধুনিক প্রযুক্তির পাদুকার পিও (জুতার উপকরণ) মেশিনের অন্যতম কাঁচামাল হলো কেমিক্যাল। এসব কেমিক্যাল চীন থেকে আমদানি করতে হয়। যেহেতু দেশে ডলারের রেট ওঠানামা করে, তাই চীন থেকে কেমিক্যাল আমদানি করতে সমস্যায় পড়ছি। চাহিদা অনুযায়ী কেমিক্যাল পাই না। যদি চীন থেকে সহজে পাদুকা তৈরির পিও কেমিক্যাল আমদানির সমস্যা দূর করা যায়, তাহলে পাদুকা সেক্টরে উৎপাদন বাড়বে বলে তিনি জানান।
কথা হয় ভৈরব পিও ফুট ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক বাহারুল আলম বাচ্চুর সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে জানান, ভৈরবের পাদুকার গুণগত মান ভালো। এজন্য দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা পাইকারি দামে কিনতে আসেন।
বাহারুল আলম আরও বলেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে ভৈরবের পাদুকা। তবে পাদুকা ব্যবসায়ীরা পুঁজি স্বল্পতার কারণে তাদের উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না। সরকার যদি পাদুকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে, তাহলে এই খাত দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে গড়ে উঠবে।
ভৈরব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি জাহিদুল হক জাবেদ বলেন, ভৈরবের পাদুকা সেক্টর একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এখান থেকে সারাদেশে পাদুকার চাহিদা পূরণ হচ্ছে। গত ৮-১০ বছরে ৪০-৫০টির মতো আধুনিক প্রযুক্তির পাদুকা কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় উৎপাদিত পাদুকা রপ্তানিও করা হচ্ছে। তবে এসব কারখানায় যারা কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই অদক্ষ। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে উৎপাদন বাড়বে।
এসআর/জিকেএস