ভোক্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সরকারি, বেসরকারি দপ্তর বা সংস্থা প্রতিনিধি ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধির অংশগ্রহণে ‘ভোক্তা-অধিকার রক্ষায় অংশীজনের সমন্বিত ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) সকালে, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। এতে উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) আব্দুল জলিল, পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম এবং অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ও ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালকরা।
সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন- সরকারি বিভিন্ন দপ্তর/সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ, ভোক্তা সংগঠন তথা কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এবং কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও সমিতির প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।
অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) আব্দুল জলিল স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ভোক্তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অধিদপ্তরের সব অংশীজন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে আমরা সবাই পৃথকভাবে কাজ করছি। কিন্তু আমরা সবাই যদি সমন্বিতভাবে কাজ করি তাহলে সহজেই ভোক্তাদের গুণগত সেবা প্রদান সম্ভব হবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমরা সব অংশীজন একসঙ্গে কাজ করলেও ভোক্তা তথা জনগণের সন্তুষ্টি অর্জনে কোথাও একটি গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। আমরা যদি সবাই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের কাজটি সমন্বিতভাবে সম্পাদন করতে পারি, তাহলে একটি মাইলফলক অর্জন সম্ভব হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের প্রধান সংস্থা হিসেবে আমরা সরাসরি কোর সার্ভিস প্রদান না করলেও অন্যান্য দপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত সেবাগুলো সঠিকভাবে প্রদান করা হচ্ছে কিনা তা আমরা তদারকি করছি। তিনি বলেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে যৌক্তিক ধারাবাহিক কার্যক্রম হচ্ছে লাভ করা। কিন্তু সেটা যৌক্তিক হতে হবে। অযৌক্তিক লাভ করে ভোক্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।
আলোচনায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ তথা জনগণের অধিকার রক্ষায় বেসরকারি/অসরকারি বিভিন্ন প্রেসার গ্রুপ কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি ক্যাব, কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, এফবিসিসিআইর কথা বলেন এবং ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে বর্ণিত সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, বিদ্যমান আইনটি সংশোধনের নিমিত্ত একটি কমিটি গঠন করেছেন এবং ওই কমিটির একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ উপদেষ্টার অবগতি ও পরবর্তী সভা আয়োজনের অনুমতির জন্য প্রেরণ করেন।
মুক্ত আলোচনায় কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ ব্যবসায়ীদের মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধের ক্ষেত্রে নিবন্ধনহীন মিডিয়া পরিহারের পাশাপাশি অভিযান চলাকালে যুক্তিতর্কের অংশ বাদ দিয়ে শুধু বিচারের রায় ঘোষণার বিবৃতি প্রচার করার পরামর্শ দেন।
এ সময় বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক বিপু চৌধুরী বলেন, আমরা মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম চাহিদা খাবার সরবরাহ করে থাকি। মানসম্মত খাবার নিশ্চিতের লক্ষ্যে আমরা অধিদপ্তরের কার্যক্রমে সহযোগিতা করে থাকি। তিনি মানহীন পণ্য ব্যবহারকারী রেস্তোরাঁর পাশাপাশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যৌক্তিক বলে মনে করেন। এ ছাড়াও বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না এবং লাইসেন্স না পেলে রেস্তোরাঁগুলোকে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জরিমানা করা হচ্ছে বলে জানান। তিনি অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির লাইসেন্সের বিষয়টি মনিটরিং করার অনুরোধ জানান। তিনি ভোক্তা সাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতায় সচেতনতামূলক লিফলেট প্রস্তুত ও প্রচার করার প্রস্তাব দেন।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের গবেষণা কর্মকর্তা মিশন ভূঁইয়া অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে তাদের সম্পৃক্ত করার অনুরোধ জানান। তিনি অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত ভোক্তা সেবার মান উন্নত করার লক্ষ্যে অধিদপ্তরের জনবল সংকট সমাধান করা উচিত বলে মনে করেন। এছাড়াও তিনি পণ্যের উৎপাদন কেন্দ্রের অভিযান পরিচালনার জন্য অধিদপ্তরের প্রতি অনুরোধ জানান।
কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতির সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, সবজি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। অফ সিজনে অভিযান করলে সবজির দাম বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনার অনুরোধ জানান।
ক্যাবের কেন্দ্রীয় সদস্য আবুল কালাম আজাদ খাদ্যের গুণগত মান ও মানসম্মত ঔষধ নিশ্চিত করার পাশাপাশি উৎপাদক পর্যায়ে মনিটরিং করার অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সুলতানান নাসিরা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে তাদের প্রতিনিধি রাখার অনুরোধ করেন। এছাড়াও তিনি পাকা রসিদ নিশ্চিতের পাশাপাশি উৎপাদক পর্যায়ে মনিটরিং করার অনুরোধ জানান।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা গৌতম কুমার বিশ্বাস বলেন, সরকারি বিভিন্ন দপ্তর/সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত অভিযান মূলত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সরকার কর্তৃক পণ্যের যৌক্তিক লাভের মার্জিন ঠিক করে দেওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন বলেন, অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে ব্যবসায়ীদের যেন মিডিয়া ট্রায়ালের স্বীকার না হতে হয়। অভিযানের ভিডিওতে যেন ব্যবসায়ীর কথাও থাকে। তিনি তেলের মান পরিমাপ করার জন্য কিট ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। এছাড়াও অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধি রাখার অনুরোধ জানান।
নিউমার্কেট বনলতা কাঁচাবাজার সমিতির প্রতিনিধি শফিউল্লাহ বলেন, আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে। ব্যবসায়ীরা যদি নিয়ম মেনে সচেতনভাবে ব্যবসা করে তাহলে অভিযানের প্রয়োজন হবে না।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সচিব রায়হান উদ্দিন বলেন, আমরা অধিদপ্তরের সার্বিক কার্যক্রমে যথারীতি সহযোগিতা করে আসছি। অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানের ফলে যেন দোকানদারদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে সমন্বয় করে কাজ করার অনুরোধ জানান তিনি।
টাউন হল কাঁচাবাজার সমিতির প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান খান অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে মার্কেট সমিতির একজন সদস্যকে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদানের অনুরোধ জানান।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিনিধি এম সায়েম টিপু বলেন, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট মিডিয়াকে সতর্ক থাকার পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে ঢালাওভাবে যাচাই-বাছাই না করে মিডিয়া নেওয়ার ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সচেতন হতে হবে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সহসভাপতি গাজী আনোয়ার বলেন, ব্যবসায়ীদের মিডিয়া ট্রায়াল প্রতিরোধে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের সঙ্গে মিটিং করা যেতে পারে। ভোক্তার সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করে কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়াও ভোক্তা অধিকার বিষয়টিকে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
এফবিসিসিআইর যুগ্ম মহাসচিব মো. সাখাওয়াত হোসেন খান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও এফবিসিসিআইর যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী সমিতি ও অংশীজনের অংশগ্রহণে সেমিনার আয়োজনের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, এফবিসিসিআইর অধীন একটি মনিটরিং কমিটি রয়েছে যারা ব্যবসায়ী সমিতি ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সমম্বয়ে মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডক্টর আম্বিয়া আক্তার অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে তাদের একজন কর্মকর্তাকে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদানের অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক ডিমের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করার ফলে ডিমের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক মনিটরিং করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ঔষধ শিল্পসমিতির নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় জীবন রক্ষাকারী ঔষধের গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মোট চাহিদার ৯৮% ঔষধ দেশে উৎপাদিত হয়। রপ্তানির জন্য ও বাংলাদেশে বিক্রয়ের জন্য উৎপাদিত ঔষধের মান ও গুণাগুণ একই, আলাদা নয়। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন ফার্মেসিতে সংশ্লিষ্ট আইন ও শাস্তির বিধান সংবলিত লিফলেট দৃশ্যমান স্থানে টানিয়ে রাখা যেতে পারে ।
অধিদপ্তরের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ সেবার সীমাবদ্ধতা থাকায় অনেক সময় ভোক্তাদের প্রতিকার দেওয়া সম্ভব হয় না। এতদসত্ত্বেও ভোক্তাদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনই অধিদপ্তরের সাফল্য। এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় তিনি সরকারি-বেসরকারি দপ্তর/সংস্থা, ব্যবসায়ী ও অংশীজনসহ সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সেমিনারে অংশগ্রহণ ও মূল্যবান মতামত প্রদানের জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভোক্তা-অধিকার রক্ষায় গৃহীত কার্যক্রম আমাদের দেশের চেয়ে শক্তিশালী। সে লক্ষ্যে আমাদের দেশের কার্যক্রম বেগবান করতে হবে। সবার মতামতকে সমন্বয় করে ভোক্তা-অধিকার রক্ষায় পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের অনিয়ম বন্ধে তিনি ভোক্তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। পরিশেষে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেমিনারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।