ভোটের লড়াইয়ে দুই ‘ভূঁইয়া’, তৎপরতা নেই এনসিপির

3 hours ago 4

লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদরের ৯টি ইউনিয়ন) আসনকে ‘বিএনপির ঘাঁটি ও ‘খালেদা জিয়ার ঘর’ বলা হয়। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখান থেকে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুইবারই তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচন হয়।

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এ আসনে জোরেশোরে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিএনপিতে রয়েছে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে নির্বাচনী আলোচনায় রয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের দুই ‘ভূঁইয়া’। তারা হলেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও তিনবারের সাবেক এমপি আবুল খায়ের ভূঁইয়া এবং জামায়াতের প্রার্থী এস ইউ এম রুহুল আমিন ভূঁইয়া।

আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে এই দুই ভূঁইয়ার পক্ষে নেতাকর্মীরা প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন। রুহুল আমিন ভূঁইয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় দলের নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক ও নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আবুল খায়ের ভূঁইয়া এলাকায় যাতায়াত ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। সামাজিক অনুষ্ঠানেও অংশ নিচ্ছেন। বিভিন্ন সভায় অংশ নিয়ে তিনি নেতাকর্মীদের সংগঠিত এবং নির্বাচনের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করছেন। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন এই নেতা।

বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি আনলেও জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদের নামমাত্র তৎপরতা দেখা গেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও এবি পার্টির কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

জেলা ও রায়পুর উপজেলা বিএনপির তিনজন নেতা জানিয়েছেন, আবুল খায়ের ভূঁইয়া ছাড়াও কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ভিপি হারুনুর রশিদ ও যুবদলের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হারুন অর রশিদ হিরো মনোনয়ন চাইবেন। তারা এ সংসদীয় আসনের সন্তান।

এ বিষয়ে হারুন অর রশিদ হিরো জাগো নিউজকে বলেন, ‘দলের জন্য কাজ করছি। আমি মনোনয়নপ্রত্যাশী। দল যদি যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দেয়, তাহলে তরুণ প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবো।’

দলীয় সূত্র জানায়, গত ১ মার্চ রায়পুর উপজেলা ও পৌর যুবদলের কমিটি ঘোষণা করে জেলা কমিটি। এতে উপজেলা আহ্বায়ক আকবর হোসেন আরমান ও পৌর আহ্বায়ক নুরে হেলাল মামুনকে মনোনীত করা হয়। কিন্তু আরমান-মামুনকে মেনে নেননি খায়ের ভূঁইয়া ও নতুন কমিটিতে থাকা তার অনুসারীরা। তারা আরমান-মামুনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে একাধিকবার বিক্ষোভ-সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এরপর খায়ের ভূঁইয়ার সঙ্গে ওই নেতাদের একাধিকবার দেখা-সাক্ষাৎ হলেও এখনো ‘মনের মিল’ হয়নি—এমনটিও জানিয়েছেন উপজেলা বিএনপির সিনিয়র তিন নেতা।

যদিও সম্প্রতি যুবদলের পৌর ও উপজেলা কমিটিতে থাকা নেতাদের নিয়ে জেলা নেতারা সভা করেছেন। শহরের মিয়াজী মার্কেটের বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ের ওই সভায় ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ দুই নেতা জানান, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় বিএনপির তিনটি পক্ষ রয়েছে। যদিও খায়ের ভূঁইয়া প্রশ্নে তারা ‘ওপরে ওপরে’ একাট্টা। গত ৬ সেপ্টেম্বর রায়পুর পৌর ও উপজেলা বিএনপির সম্মেলন হয়। এরপর উপজেলা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলাম মিঠু ও পৌর কমিটির সভাপতি এ বি এম জিলানী রাজনৈতিক মাঠে খায়ের ভূঁইয়ার পক্ষে শক্ত ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।

উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সফিকুর রহমান ভূঁইয়া, পৌর বিএনপি নেতা আবদুর জাহের মিয়াজী, শফিকুল আলম আলমাস এক পক্ষ, অন্য পক্ষে পৌর কমিটির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম লিটন ও সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুল হকসহ কয়েকজন রয়েছেন। যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবকদল, কৃষকদলের শীর্ষ নেতারাও বিভক্ত বলে জানা গেছে।

নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময়ে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে ২৯ থেকে ৩২ জন করে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তখন কাকে রেখে, কাকে বাদ দেবেন—এ অবস্থায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজেই দুইবার এখানে প্রার্থী হন। বর্তমানে বিএনপির শুধু আবুল খায়ের ভূঁইয়াই মাঠে আছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে খায়ের ভূঁইয়া দলের টিকেট পাবেন—এটা প্রায় নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা।

অতীতে নির্বাচিত যারা

রায়পুর উপজেলা ও সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে লক্ষ্মীপুর-২ আসন। হালনাগাদ তালিকায় এখানে ভোটার দুই লাখ ৫৯ হাজার ৭১৭ জন।

নির্বাচনের তথ্য ঘেঁটে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা গঠিত হয়। ১৯৮৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর-২ আসনে ১৩ বার জাতীয় সংসদ ও এর উপ-নির্বাচন হয়। এর মধ্যে বিএনপি প্রার্থী ছয়বার, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ তিনবার করে এবং একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে চৌধুরী খুরশিদ আলম জাতীয় পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯১ সালে মোহাম্মদ উল্যাহ ও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে আবুল খায়ের ভূঁইয়া বিএনপি থেকে জয়ী হন। ১৯৯৬ এর জুনের নির্বাচনে জয়ী হন খালেদ জিয়া। তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে হাতছাড়া হয় বিএনপির। সেপ্টেম্বরের উপ-নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের হারুনুর রশিদ। সেবার প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা।

এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন খালেদা জিয়া। তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে জয়ী হন আবুল খায়ের ভূঁইয়া। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবুল খায়ের ভূঁইয়া বিএনপির মনোনয়নে আবার নির্বাচিত হন।

২০১৪ সালে ‘বিনা ভোটের’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ নোমান। এরপর ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোটে’র নির্বাচনে ‘টাকার কুমির খ্যাত’ স্বতন্ত্র প্রার্থী শহিদুল ইসলাম পাপুল নির্বাচিত হন। তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামও সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন।

মানব ও অর্থ পাচারের অভিযোগে ২০২০ সালের ৬ জুন কুয়েতে গ্রেফতার হন পাপুল। এরপর নির্বাচন কমিশন আসনটি শূন্য ঘোষণা করলে উপ-নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালেও নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন।

আরও পড়ুন:
বিএনপির দিকে তাকিয়ে এলডিপির শাহাদাত, আলোচনায় উপদেষ্টা মাহফুজ
ভোটের হাওয়ায় এলাকায় ভিড় করছেন বিএনপির প্রবাসীরা
পলাতক ওসমান পরিবার, খেলায় এগিয়ে বিএনপি
পলাতক শামীম ওসমানের আসনে আলোচনায় যারা
হারানো আসন ফিরে পেতে মরিয়া বিএনপি, মাঠে আছে জামায়াত-এনসিপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে নোয়াখালী জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক বোরহান উদ্দিন আহমেদ মিঠু লড়েছেন। এবারও চাইলে তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে জানিয়েছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।

নির্বাচন ঘিরে প্রচারণা চালাচ্ছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী রায়পুর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন। অন্যদিকে কেফায়েত হোসেন তানভীরকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে এবি পার্টি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রায়পুর পৌর জামায়াতের একজন নেতা জানান, দলের ঘোষিত প্রার্থী প্রবীণ হওয়ায় যখন-তখন সময় দিতে পারেন না। শারীরিকভাবেও তিনি অসুস্থ। এজন্য প্রার্থী বদল করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ‘এখানে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদের খতিব সাঈয়্যেদ আনোয়ার হোসাইন তাহেরী জাবেরী আল মাদানিকে প্রার্থী করা হলে আমরা নিশ্চিত বিজয়ী হবো।’

চরপাতা গ্রামের বিএনপি সমর্থক ইমরান হোসেন মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা চাইবো জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাকে বিএনপি প্রার্থী করুক। এতে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, এলাকার উন্নয়ন হবে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চররুহিতা এলাকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের এ জনপদে একটি কথা প্রচলিত আছে—বিএনপি থেকে কলাগাছ দাঁড়ালেও জিতবে। তবে দিন দিন জামায়াতের ভোটও বাড়ছে। তারা নারীদের টার্গেট করে সাংগঠনিক কাজ করছেন। এর ফল তারা ভোটে পাবেন।’

বিএনপির মনোনয়ন প্রসঙ্গে ভিপি হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমি অবশ্যই দলের মনোনয়ন চাইবো। দল আগেও একবার আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে।’

রায়পুর উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আবদুল আউয়াল রাছেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে দাওয়াতি কাজ ও প্রার্থী পরিচিতি সভা করছি। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও সাংগঠনিক শাখায় নিয়মিত মতবিনিময় হচ্ছে। এ কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চলছে। জয়ের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’

উপজেলা বিএনপির সভাপতি জেড এম নাজমুল ইসলাম মিঠু বলেন, ‘১৭ বছর আমাদের দল অগোছালো ছিল। এখন তৃণমূল পর্যায়ে ভোটের মাধ্যমে গোছানো হচ্ছে। নির্বাচনের লক্ষ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি ও গণসংযোগের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।’

জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এখন তারা দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে। হামলা-মামলার শিকার হয়েও আমাদের নেতাকর্মী এক ছিল, এখনো আছে। নির্বাচনের জন্য আমাদের সাংগঠনিক প্রস্তুতি রয়েছে। আশা করি জনগণ আমাদের পক্ষে রায় দেবে।’

জামায়াতের প্রার্থী ও জেলা কমিটির আমির রুহুল আমিন ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের চারটি আসনেই কার্যক্রম চলছে। পরবর্তী সময়ে দলের চূড়ান্ত সংকেত পেলে আসন ছাড়তে হলে ছাড়া হবে। নিয়মিতভাবে আমাদের গণসংযোগ, কেন্দ্র কমিটি ও ভোটারদের নিয়ে মতবিনিময় হচ্ছে।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ও দলের রায়পুর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘নির্বাচনের লক্ষ্যে আমরা এরইমধ্যে ওয়ার্ড কমিটিগুলো শেষ করেছি। এখন প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগ চলছে। আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের কাছে যাচ্ছি।’

কেকে/এসআর/এমএমএআর/এমএস

Read Entire Article