বিলকিস নাহার মিতু
দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী সিলেট। হাওর, নদী, পাহাড় সবই মিলিত হয়েছে প্রকৃতিকন্যা সিলেটে। আমাদের ফিল্ড ওয়ার্কের জন্যও বেছে নেওয়া হয় নয়নাভিরাম সিলেটকে। সিলেটের শাহ পরাণ মাজার থেকে সামনে ধনকান্দি গ্রামে আমরা ফিল্ড ওয়ার্ক শুরু করি ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে। পরের দিন ভোর ৭টায় আমরা ফিল্ডে নেমে পড়ি। সেখানে ১০টা পর্যন্ত কাজ করে সকালের নাস্তা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ৫৫ জন রওয়ানা দিই ভোলাগঞ্জের উদ্দেশ্যে।
গাড়ি ১১টার পরে ছাড়লো। জানালা দিয়ে পাহাড়ি চা বাগানগুলো দেখলাম। কী চমৎকার ধাপে ধাপে সজ্জিত। সিলেট অঞ্চলে বাঁশ ভালো জন্মে। প্রতি বাড়িতেই বাঁশঝাড় দেখা যায়। নানান সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে প্রায় ১টার সময়ে ভোলাগঞ্জে পৌঁছলাম। সেখানে নেমে গ্রুপ ফটো তুলে চলে গেলাম খেয়াঘাটের কাছে। সেখান থেকে নৌকায় করে ওপারে গেলেই সাদা পাথরের দেখা মিলবে। প্রতিটি নৌকায় ৮ জন করে উঠতে পারবে। স্যার বললেন, ৫ জন মেয়ে ৩ জন ছেলে মিলে উঠে যাও। স্যারের আদেশ অনুযায়ী আমরা নৌকায় উঠলাম। নৌকায় উঠেই শুরু হয়ে গেছে ফটোশ্যুট। সবাই তড়িঘড়ি করে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কারণ নৌকা পার হতে বেশি সময় লাগে না।
এরই মধ্যে ভোলাই নদ পার হয়ে সবাই নৌকা থেকে নেমে গেলাম। নামার পরে চোখের সামনে আপাততঃ মরুভূমি ছাড়া কিছু দেখছি না। একটি পাথরের ছিটেফোঁটাও নেই। এর কারণও সবাই জানেন যে, পাথর চুরি হয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশে সারি সারি নানান রকমের দোকান আছে। মিনিট দশেক হাঁটার পরে দূরে পাথর চোখে পড়লো। আমরা দলবেঁধে সব হাটঁছি সামনের দিকে। এবার কাছে চলে এসেছি সবাই। স্বচ্ছ জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি ঠান্ডা শীতল পানির স্রোতে। শত শত মানুষের ভিড় সেখানে। কেউ পানি ছেটাচ্ছে, কেউ সাঁতার কাটছে। সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত ছবি তোলা নিয়ে।
স্যার-ম্যাম এলে আমাদের বন্ধুরাও সবাই ভিজতে চলে গেলো। আমি আর সাথে দুই বান্ধবী শুধু ভিজতে পারিনি। একটু ছায়ায় পাথরের ওপরে বসেছিলাম। আমাদের বন্ধুদের দেখছি ভীষণ মজা করছে। একজন আরেকজনকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। শুরুতে সবাই অল্প অল্প ভিজছিলো। পরে সবাই স্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দিয়ে বেশ আনন্দ পাচ্ছিলো। কিন্তু চোখের সামনে অনেককেই পিচ্ছিল পাথরের ওপরে পড়ে যেতে দেখেছি। আমিও কয়েকবার পরে যাচ্ছিলাম কিন্তু একেবারে পড়ে যাইনি। আমরা তিন মেয়ে বাদে ট্যুরে প্রত্যেকেই পাথরে আঘাত পেয়েছে। প্রিয়াঙ্কা আর ইশিতার তো আঘাতে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে।
দুপুরের প্রখর রোদে প্রচণ্ড গরম যেমন লাগছিল; চারদিকের সৌন্দর্য সেই গরমের কষ্টকেও যেন ভুলিয়ে দেয়। এরপর স্যার, ম্যাম সবার সাথে ভিজতে গেলে আমাদের জিনিসপত্র পাহারার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। সবাই স্যার, ম্যামের সাথে গ্রুপ ফটো তুললো সাদা পাথরের স্বচ্ছ পানির ধারার মাঝে। এই ভ্রমণের সবচেয়ে লোমহর্ষক মুহূর্ত ছিল ছেলেদের। ৫-৬টা ছেলে যারা সাহস করে একদম দূরে ঝরনার স্রোতে গোসল করতে গেছিলো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো, এরা সবাই স্রোতের সাথে আরও দূরে ভেসে যাচ্ছিলো। যেখানে যাওয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা। ওরা কোনোভাবেই নিজেদের ভারসাম্য রাখতে পারছিলো না। যত চেষ্টা করছে; ততই আরও দূরে ভেসে যাচ্ছে। সবাই বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল কিন্তু সেই চিৎকার শোনা যাচ্ছিল না।
একপর্যায়ে আল্লাহর রহমতে একেক জন একেকভাবে বেঁচে ফিরে আসে। ওদের প্রত্যেকে সেদিন নাকি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। বলাবলি করছিল, আজ নাকি মিডিয়ায় খবর হয়ে যেতো বিএল কলেজের ছাত্রদের মৃত্যুর! ভ্রমণের এই অংশটুকু হৃদয়বিদারক ছিল! সবাই ফিরে এলে আমরা বিকেলে নৌকা পার হয়ে খেয়াঘাটের পাশে রেস্টুরেন্টে হাঁসের মাংস আর নানান প্রকার ভর্তা দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করি। এখানে হাঁসের মাংসটা ভালো মজা।
খাওয়া শেষে আমরা আশপাশের দোকানপাট ঘুরে দেখি। ঝিনুকের তৈরি নানান অর্নামেন্টস সেখানে পাওয়া যায় সুলভ মূল্যে। সন্ধ্যা হলে সবাই গাড়িতে উঠে পড়ি। তখন আকাশে চাঁদটা বেশ ভালোভাবেই উঁকি দিচ্ছে। আমরা এরপর গিয়ে পৌঁছলাম ‘সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে’। সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরে দেখে আমরা আবারো ফিরে এলাম হোটেল আপন প্যালেসে। সিলেট ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনও আমার কাছে অত্যন্ত চমৎকার এবং লোমহর্ষক ছিল। সুযোগ পেলে আবারও আসবো উপভোগ করতে।
লেখক: অনার্স ৩য় বর্ষ, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।
এসইউ/জিকেএস