চরু হক
আমি তাঁকে ডাকতাম জ্যাঠামশাই। সৌভাগ্যবশত আমার বাবা কবি নূরুল হক তাঁর ছাত্র ছিলেন, নেত্রকোনা আশুজিয়া হাইস্কুলে সিক্স সেভেনে পড়ার সময়কাল থেকেই। প্রকৃতিমাতার পর কবি নূরুল হকের শিক্ষার হাতেখড়ি মূলত তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল। এইরকম একজন শক্তিমান মানুষের স্নেহের ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন আমার বাবা, প্রথমে স্কুলে, তারপর কলেজের শিক্ষক হিসেবে পেয়ে। তাঁর সততা, সারল্য, প্রগতিশীলতা, মুক্তচিন্তা, কর্মনিষ্ঠা,মানসিক ঔদার্য সবকিছু সূর্যের মতো জাজ্বল্যমান। তিনি অধ্যাপক যতীন সরকার, আমার জ্যাঠামশাই।
আমরা তখন থাকতাম নেত্রকোনায়। সাতপাই, আমার নানাবাড়িতে। সামনেই মগড়া নদী, তার মিঠা জল আর কুলুকুলু ধ্বনিতে ধুয়ে দিত অন্তর। সেই মগড়ার কোলঘেঁষা সবুজ মাঠের পারে আমাদের ছোট্ট বাড়িটিতে মাঝে মাঝেই তাঁকে আসতে দেখতাম। তাঁর সাথে আসতেন আরও অনেকে। চিন্তক, লেখকগোষ্ঠীর আড্ডা বসতো সেখানে। আম্মা চা-নাস্তা বানাতেন, রান্নাবান্না করতেন; আমি সামনে গেটের পাশে কমলালেবু আর সুপারি গাছের নিচে সাথীদের নিয়ে খেলায় ডুব দিতাম।
জ্যাঠামশাই ছিলেন শিশুর মতো সরল। মহীরুহের মতো বিশাল একজন মানুষের এইরকম সারল্য চোখ এড়ানো অসম্ভব। তাঁকে দেখেই শিখেছি মানুষ যত বড়ো মাপের হয়, ততই শিশুর মতো সরল, নিষ্পাপ হতে থাকে। জেনেছি ফলবান বৃক্ষ নতমুখী হয়। অনেক পরে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, একবার তাঁদের ময়মনসিংহের বাসায় বেড়াতে গেলাম। আগেও যেতাম মাঝেমধ্যে, কিন্তু সেবার থাকলাম প্রায় মাসখানেক। মায়াঘেরা একটা বাড়ি, তাতে জ্যাঠিমার মুখখানা যেন মায়ের আদলে বানানো। জ্যাঠিমার সেই সময়কার আদর স্নেহের কথা কোনদিন ভুলবো না। সারাদিন ঘোরাঘুরি, বই পড়া, বিকেলবেলা বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়া, সবই চললো জোরকদমে।
তখন ঝিনুক হলো আমার খেলার সাথী। খাই দাই, ঝিনুকের সাথে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই। রাত নামলে ঝিনুকের সাথে ঘুমাই। ঝিনুক জ্যাঠামশাই জ্যাঠিমার মেয়ে, যাকে তাঁরা মনু বলে ডাকত। জেঠিমার মুখে মনু ডাক শুনে আমিও তাকে মনু ডাকতাম। তার ভালো নাম সুদীপ্তা সরকার। ভীষণ ভালো কবিতা আবৃত্তি করতো, আর ছোট মেয়ে হলে কি হবে, বক্তৃতায় ছিল সেই রকম ক্ষুরধার। আমি বিকেল হলেই জ্যাঠামশাইয়ের সাথে মনুকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে যাই, আর হাঁ করে মনু অর্থাৎ ঝিনুকের আবৃত্তি, আলোচনা এগুলো শুনি। ময়মনসিংহের বাঘা বাঘা মুক্তমনা, প্রগতিশীল পণ্ডিতদের মিলনস্থল ছিল সেইসব অনুষ্ঠান। তাঁদের কন্ঠের তেজ আর চোখের ঔজ্জ্বল্য অনুবাদ করে দিত তাঁদের অন্তরের ভাষা।
এক সাম্যবাদী বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠেছিল তখন ময়মনসিংহের ঊর্বর ভূমি। আর তাঁর সূর্যসন্তান, মধ্যমণি ছিলেন জ্যাঠামশাই। সবার শেষের দিকে তিনি যখন মঞ্চে উঠতেন বক্তৃতা দেয়ার জন্য, পিনপতন নিস্তব্ধতা দেখা দিত চারধারে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সম্মোহিত হয়ে থাকতেন দর্শক-শ্রোতারা, সেই জাদুকরী কণ্ঠের সামনে।
তিনি ছিলেন কণ্ঠের যাদুকর। তার দীপ্ত উচ্চারণে উঠে আসতো জীবনের গূঢ় তত্ত্ব। মার্কসবাদী দর্শনে দীক্ষিত অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এই মহামানবের সব চিন্তার মূল সূত্র ছিল সাধারণ মানুষ ও তাদের চিন্তার মুক্তি। আমি শুনতাম আর শুনতাম, বুঝতাম না কিছুই তেমন একটা, আর কেবল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে টানটান বসে থাকতাম।
জ্যাঠামশাইয়ের বাসায় সারাদিনই লোকজন আসা যাওয়া করতো। বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা হতো। তাঁর যেন কোনো কিছুতেই ক্লান্তি ছিল না। সারাদিনই চলতো বইপড়া আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা। বিজ্ঞান, জীবন, দর্শন, লোকধর্ম, লোকোজ্ঞান, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কী নেই সেই আলোচনায়। সব নদী যেমন মোহনায় মিশে তেমনই সব পথ, সব মত, সব ধর্ম একাকার হয়ে মিশে যেত তাঁর দিগন্তপ্রসারী মুক্তচিন্তার বাতায়নে।
সেখানে থেকে আমারও কিছু কিছু বই পড়ার অভ্যাস হলো। জ্যাঠামশাইয়ের ঘরভর্তি বই। ড্রয়িং রুমের সবদিকে শুধু বই আর বই—এ বলে আমাকে দেখো, ও বলে আমাকে দেখো। আমি ডুবে যেতাম এক বিশাল বইয়ের সাম্রাজ্যে; চিন্তার, কল্পনার জগতে। সবচেয়ে অবাক হলাম যখন দেখলাম শোবার ঘরটা বইয়ে একেবারে ঠাসা। বিছানার পাশে, বিছানার উপরে র্যাক তৈরি করে রাখা বিচিত্র ধরনের বই। নড়াচড়ার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। বইয়ের গন্ধটা অক্সিজেনের মত শ্বাসভরে নিতাম। জ্যাঠামশাই আমাকে বিভিন্ন বই হাতে তুলে দেন, কোনোটা আবার সুদীপ্তা আর আমাকে বুঝিয়ে দিতেন। আর বলতেন প্রচুর পড়তে হবে, প্রচুর লিখতে হবে, প্রতিদিন নিয়ম করে। প্রতিদিন নিয়ম করে পড়ার আর লেখার এই চর্চাটা তিনি মোটামুটি আজীবন অব্যাহত রেখেছেন।
হাঁটতেন প্রচুর। হাঁটতে তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই। আমরাও তখন ফড়িংয়ের মতো পা দিয়ে লাফাতে লাফাতে তাঁর পিছু পিছু যেতাম। ময়মনসিংহের লাল ইটের বাড়িগুলো আর রাস্তাগুলোর সাথে কিছুদিনের মধ্যেই আমার সখ্য হয়ে গেল। Simple living high thinking এর আদর্শ উদাহরণ অধ্যাপক যতীন সরকার।
সময় সময় কলেজে গিয়ে তাঁর ক্লাস করতাম,যদিও আমি তখন দুধভাত অর্থাৎ নিতান্তই শিশু। উঠতি কৈশোরে আমার বাবা কবি নুরুল হককে এই মহিমান্বিত শিক্ষক স্নেহের নিগড়ে বেঁধে ফেলেছিলেন অনায়াসেই। কলেজজীবনেও তিনি হয়ে উঠলেন কবি নুরুল হকের দীপজ্বালানিয়া প্রথ-প্রদর্শক শিক্ষক, অভিভাবক, প্রমিথিউস। এবং বাবা আমৃত্যু লালন করেছেন তাঁর শিক্ষকের মহান আদর্শ। আমি যখন ময়মনসিংহ বেড়াতে গিয়ে তাঁর ক্লাস করতাম, তখন অবাক হয়ে যেতাম তার ক্লাস নেয়ার জাদুকরী কৌশল ও দক্ষতা দেখে। বিশেষত খুবই মজা পেতাম তাঁর ব্যাকরণের ক্লাসগুলো- এত সহজ করে হাস্যরসে কৌতূকে পূর্ণ করে তিনি পড়াতেন যে কখনো মনেই হতো না ব্যাকরণের মতো একটি কাঠখোট্টা, ভীতিকর বিষয় তিনি পড়াচ্ছেন। ব্যাকরণের ভয় অকারণ তা তিনি প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন।
শিক্ষক হিসেবে তিনি একজন অসাধারণ বড় মাপের শিক্ষক কেননা তিনি শুধু বইয়ের পড়াই পড়িয়ে যেতেন না বরং পড়ানোর ছলে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের মস্তিষ্কে প্রোথিত করে দিতেন চিন্তার বীজ, জানার উৎসুক্য -জীবনের প্রতি, শেকড়ের প্রতি এক অমোঘ টান।
একদিন অনেক জোরে বর্ষা নামলো। মেঘের ডমুরু ঘন বাজে আকাশে। জ্যাঠামশাই আমাদেরকে অর্থাৎ আমাকে আর মনুকে কালিদাস বা এরকম একটা বই পড়াতে লাগলেন। সেই সময়টাতে বাবা আসলেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বুঝলাম জ্যাঠিমার হাতের মজার মজার খাবার খাওয়ার দিন শেষ। বিদায়ের ঘন্টা বেজেছে। জ্যাঠামশাই আমাকে আর মনুকে মার্কেটে পাঠালেন। মনু অর্থাৎ সুদীপ্তা আমার জন্য সুন্দর একসেট নেকলেস উপহার কিনে দিল। কোনো কোনো বিদায়ে বুকের মাটি ভিজে আসে। সেদিনটা ছিল সেরকম একটি বিদায়।
দিন গড়ায়। শিক্ষকতার অবসরে জ্যাঠামশাই নেত্রকোনা চলে আসলেন তার গড়ে তোলা বাণপ্রস্থে। আমি ঋষির আশ্রম দেখিনি তবে জ্যাঠামশাইয়ের বাণপ্রস্থ দেখে মনে হয়েছিল যেনো এক আশ্চর্য সমাহীত এক সবুজ প্রশান্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেনো কোনো এক ঋষির আশ্রম। প্রাচীর ঘের দেয়া একটি ছোট বাড়ি, এত সবুজ! এত গাছপালায় ঘেরা, এত পাখপাখালির কলকাকলিতে আকীর্ণ হতে পারে, এত পুষ্পশোভায় শোভিত হয়ে চিরবসন্তকে আহ্বান করতে পারে, তা চাক্ষুষ না দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হবে।
শান্ত স্নিগ্ধতা চারদিকে। এরই মাঝে সবুজের ফাঁকে ফাঁকে পাখিদের কিচিরমিচির যেন বীণার মৃদু ঝংকার। ঘরের ভেতর অজস্র বই, জ্ঞানপিপাসুদের অবিরাম যাওয়া আসা আর ঘরের ভেতর সরল শিশুর মত হৃদয় নিয়ে হাসিমাখা মুখে বসে আছেন এমন একজন মহীরূহ, যিনি সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন কেবল জ্ঞানচর্চা আর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসায়। আমি তাঁকে উৎসর্গ করা আমার ‘আমার ভেতর হাওয়ার বাসাবাড়ি’ কবিতার বইটি ভয়ে ভয়ে তাঁর হাতে তুলে দিলাম। জ্যাঠামশাই শিশুর সারল্য নিয়ে হাসিমুখে আমাকে আশীর্বাণী দিলেন।
একজন আদর্শ শিক্ষক অধ্যাপক যতীন সরকার। তিনি তাঁর কথায়, চিন্তায় এবং জীবনাচরণে সাম্যবাদী দর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। প্রকাশ ঘটিয়েছেন একজন সফল আদর্শ শিক্ষকের প্রতিবিম্ব। বলে গেছেন একজন আদর্শ শিক্ষক কেমন হওয়া উচিত। তাঁর মতে, জন্ম নিলেই শিক্ষক হওয়া যায় না, একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হলে সারাজীবন শিক্ষার্থী হয়ে থাকতে হয়।
এই অবক্ষয়ের ধারাপাতের মধ্যে থেকেও শোনাতে চেয়েছেন আশার বাণী। আর তাই অকপটেই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উচ্চারণ করতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথের মতো, ‘যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই’। যে সত্য কঠিন, সেই কঠিনেরে ভালোবেসেছেন তিনি অবলীলায়। সে কখনো করেনি বঞ্চনা।
কারও কারও আশীর্বাণী স্বর্গীয় সুষমায় আচ্ছাদিত। ভাষাতীত লাবণ্যে চর্চিত আর দীপ্ত প্রাণের মহিমায় উদ্ভাসিত। সেই রকম একজন ক্ষুরধার শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, মুক্তচিন্তক, বুদ্ধি ও মানবিকতার ধারক, শুদ্ধাচারী হিরন্ময় পুরুষ জ্ঞানতাপস যতীন সরকার। এই ভঙ্গুর সময়ের মোড়ে দাঁড়িয়ে তাঁর এ অনন্তে লীন হওয়া আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
লেখক: কবি ও শিক্ষক
এমকেআর/জিকেএস