মাহমুদা আক্তার
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে বিস্তৃত কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত কেবল পর্যটনকেন্দ্র নয়; এ যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সৈকত বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক বালুকাবেলা হিসেবে খ্যাত। নীল সমুদ্রের ঢেউ, সোনালি বালুর বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া সূর্যের আলো; সব মিলিয়ে ভ্রমণের জন্য এটি এক অসাধারণ গন্তব্য।
কক্সবাজারের সকাল যেন অন্যরকম সৌন্দর্যে ঘেরা। ভোরের আলো ফুটতেই সমুদ্রের ওপর রঙিন আভা ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে যখন সোনালি আলো ঢেউয়ের ওপর খেলে যায়, মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজ হাতে এক জাদুময় পর্দা উন্মোচন করছে। ভোরের হালকা বাতাস, দূরের নৌকায় জেলেদের ব্যস্ততা আর ঢেউয়ের গর্জন একত্রে সৃষ্টি করে এক প্রশান্তিময় অনুভূতি।
দুপুরের কক্সবাজার প্রাণবন্ত এবং সরগরম। নীল জলরাশিতে তখন ভিড় জমে পর্যটকদের। কেউ সমুদ্রস্নানে মগ্ন, কেউ আবার জেট স্কি বা প্যারাসেইলিংয়ের রোমাঞ্চ উপভোগ করছেন। সৈকতের পাশে সারি সারি নারিকেল গাছের ছায়ায় বসে শুঁটকি মাছের ঝাঁঝালো গন্ধ আর ভাজা চিংড়ির গরম গরম স্বাদ পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে কক্সবাজার যেন আরেকটি নতুন সাজে সেজে ওঠে। সূর্যাস্তের সময় দিগন্তজোড়া আকাশে লাল, কমলা আর সোনালি রঙের মিশেল তৈরি করে এক অপূর্ব দৃশ্য। সমুদ্র তখন শান্ত, ঢেউয়ের শব্দ আবিষ্কার করে একটি ভিন্ন ধাচের কক্সবাজার। অনেক পর্যটক এ সময় সৈকতে হাঁটতে ভালোবাসেন। হাতের মুঠোয় প্রিয়জনের হাত, পায়ের নিচে ঠান্ডা বালুর স্পর্শ, যা সারাজীবন মনে গেঁথে থাকে।
কক্সবাজারে শুধু মূল সৈকতই নয়, রয়েছে আরও বহু দর্শনীয় স্থান। লাবণী পয়েন্টে ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা, সুগন্ধা পয়েন্টে কোলাহল আর কেনাকাটার আনন্দ, হিমছড়ি ও ইনানীর প্রবাল পাথরের সৌন্দর্য; সব মিলে কক্সবাজার পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ আনন্দ দেয়। ইনানীর স্বচ্ছ জল আর সবুজ পাহাড়ের পটভূমি সমুদ্রের নীলের সঙ্গে মিশে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতোই রূপ ফুটিয়ে তোলে।
এ ছাড়া কক্সবাজারের সংস্কৃতি ও মানুষের আতিথেয়তায়ও সেরা। স্থানীয় মানুষজনের আন্তরিকতা, হাসিমাখা মুখ আর পর্যটকদের প্রতি সহযোগিতার মানসিকতা যে কারো মন জয় করে নেয়। এখানে এসে আপনি চিংড়ি, লবস্টার, কোরাল মাছ কিংবা কাতলার তাজা স্বাদ উপভোগ করতে পারেন, যা অনেক রেস্তোরাঁয় সরাসরি সমুদ্র থেকে এনে রান্না করা হয়।
প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য কক্সবাজার এক অবিরাম প্রেরণা। শীতকালে যখন আবহাওয়া শীতল ও পরিষ্কার থাকে; তখন আকাশের নক্ষত্রভরা রাত ও পূর্ণিমার আলোয় ঝলমলে সমুদ্র যেন এক রূপকথার জগৎ। অন্যদিকে বর্ষাকালে সমুদ্রের রূপ হয় ভিন্ন। তখন ঢেউ হয় উত্তাল, আকাশে কালো মেঘের ভেলা আর বৃষ্টির ছোঁয়া এক ভয়ংকর অথচ রোমাঞ্চকর সৌন্দর্য উপহার দেয়।
তবে কক্সবাজারের সৌন্দর্য রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আবর্জনামুক্ত রাখা, প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের ক্ষতি না করা এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকে সম্মান করা; এসব মেনে চললে কক্সবাজারের অপার সৌন্দর্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অটুট থাকবে। কক্সবাজার শুধু ভ্রমণস্থান নয়, এটি এক অনুভূতি—যা মনকে শান্ত করে; আত্মাকে প্রশান্তি দেয়। ঢেউয়ের প্রতিটি শব্দ যেন বলে যায়, জীবনকে উপভোগ করতে শেখো।
কক্সবাজারে যেতে হলে সড়ক অথবা রেলপথে ভ্রমণ করতে পারেন। ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে নিয়মিত বাস, ট্রেন চলাচল করে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী বিভিন্ন বাস সার্ভিস আছে। নন-এসি বাসের ভাড়া ৭৫০-৯৪০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১১০০-২৭০০ টাকা। ট্রেনে যেতে চাইলে কক্সবাজার এক্সপ্রেস এবং পর্যটক এক্সপ্রেস আছে। শ্রেণিভেদে ৬৯৫-১৫৯০ টাকা পর্যন্ত সিট ভাড়া হয়ে থাকে।
এসইউ/এএসএম