মনে অইছিন ডাকাতরা মাইরা ফালাইবো, আল্লাহ বাঁচাইছে

4 hours ago 6

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার শেষ সীমানায় অবস্থিত এনায়েতপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নেই সোয়াইতপুর উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সীমান্তঘেঁষা। সোয়াইতপুর বাজার থেকে ঘাটাইলের সাগরদীঘি বাজারের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। সাগরদীঘি ইউনিয়নের যে এলাকায় ডাকাতি হয়েছে (লক্ষণের বাঁধ) সেটির দূরত্ব আরও তিন কিলোমিটার।

সোয়াইতপুর উচ্চ বিদ্যালয় আর সোয়াইতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি একসঙ্গে। সোয়াইতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা চলে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার শতাধিক। এরমধ্যে ১৩৫ শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক আর অভিভাবক মিলিয়ে ১৮০ জন চারটি বাসে নাটোরের গ্রিনভ্যালি পার্কে শিক্ষা সফরে যাওয়ার জন্য দিনক্ষণ ঠিক হয়।

সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ভোরে চারটি বাস বিদ্যালয়ের পাশে সোয়াইতপুর বাজারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষায় থাকে। ঠিক পৌনে ৪টায় বাসগুলো নাটোরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। শিক্ষার্থীদের হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দে বাসগুলো চলছিল দ্রুত। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই অপেক্ষায় থাকা ডাকাতদল সবার আনন্দ নিমিষেই ভয় আর আতঙ্কে পরিণত করে লুণ্ঠন করে নিয়ে যায় সব।

মনে অইছিন ডাকাতরা মাইরা ফালাইবো, আল্লাহ বাঁচাইছে

যেভাবে বাসে ঘটনা

ইলেকট্রিক করাত দিয়ে একটি গাছ কেটে সড়কে ফেলে রাখে ডাকাতদল। শিক্ষা সফরের বাসগুলো আধাঘণ্টায় সোয়া ৪টার দিকে ঘাটাইল-সাগরদীঘি সড়কের লক্ষণের বাঁধ এলাকায় পৌঁছায়। এসময় সড়কে গাছ ফেলে রাখায় সামনে থাকা গাড়ি থামাতে বাধ্য হন চালক। একে একে থেমে যায় পেছনে থাকা আরও তিন বাসের চাকা। ডাকাতদল এসেছে আন্দাজ করতে পেরে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন সামনের বাসে থাকা শিক্ষক-অভিভাবকরা।

১০-১২ জনের ডাকাতদল দ্রুত পেছনের বাসে উঠে পড়ে। একেকজনের হাতে ছিল দেশীয় ধারালো বিভিন্ন অস্ত্র। সবাইকে জিম্মি করে তারা আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। গাড়িতে থাকা সবার বুক কাঁপতে থাকে থরথর করে। বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর সাখাওয়াত হোসাইন রবিন (২৫) ও অভিভাবক শহিদুল্লাহ তালুকদারকে (৩৯) মারধর করে ডাকাতদল। ডাকাতরা ঠান্ডা মস্তিষ্কে একে একে চালায় আরও দুই বাসে ডাকাতি। ছিনিয়ে নেয় এক লাখ ৪০ হাজার টাকা, ১০টি স্মার্টফোন, একটি হাতঘড়ি ও দেড় ভরির মতো স্বর্ণালংকার।

সামনে থাকা প্রথম বাসেও ডাকাতি করতে চায় ডাকাতদল। এজন্য দ্রুত তিন বাসে ডাকাতি সম্পন্ন করে। কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে পুলিশ চলে আসতে পারে ভেবে দ্রুত মালামাল লুট করে পালিয়ে যায়।

ডাকাতি চলাকালীন সামনে থাকা প্রথম বাস থেকে ৯৯৯ নম্বরে কল দেন প্রধান শিক্ষক। দুইবার কল দিলেও কলটি যাচ্ছিল না। পরে সহকারী শিক্ষক লাইলী আক্তার কল দিলে রিসিভ হয়। ঘটনাটি খুলে বললে সড়কের কাছাকাছি অবস্থানে থাকা টহল পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। পুলিশ আসার আগ মুহূর্তে পালিয়ে যায় ডাকাতদল।

মনে অইছিন ডাকাতরা মাইরা ফালাইবো, আল্লাহ বাঁচাইছে

পুলিশ আসায় সাহস ফিরে পান বেশিরভাগ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর ভয় কাটছিল না। এ অবস্থায় তাদের নিয়ে অভিভাবকরা শিক্ষা সফরে যাবেন না বলে জানান। নিজেদের বাসাবাড়িতে ফিরে যেতে চাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু অনেকের ইচ্ছায় তাদের বুঝিয়ে কিছুক্ষণ পর বাসটি গ্রিনভ্যালি পার্কের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। টাকাসহ মালামাল লুণ্ঠন হওয়ায় অনেকের পকেটে টাকা ছিল না। ফলে ইচ্ছা থাকলেও কিছু কেনাকাটাসহ মন ভরে আনন্দ করতে পারেননি অনেকে।

মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাত ১০টার দিকে ঘাটাইল থানায় এসে প্রধান শিক্ষক বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ১০-১২ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়। পরে পুলিশ পাহারায় রাত ২টার দিকে শিক্ষা সফরের বাসগুলো ফুলবাড়িয়ায় পৌঁছায়।

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসিম আহমেদ জাগো নিউজকে জানায়, তার হাতে পরিবারের একটি স্মার্টফোন ছিল। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ডাকাতদল সেটি নিয়ে গেছে। এখনো তার ভয় কাটছে না।

অষ্টম শ্রেণির মিথিলা আক্তারের ভাষ্য, গহিন বন দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাস থেমে যায়। তখন বাসে উঠে পড়ে ডাকাতদল। তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। এটি দেখে আমিসহ অন্যরা ভয় পেয়ে যায়। পরে তারা লুটপাট শুরু করে।

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসিম আহমেদ জাগো নিউজকে বলে, ‘শিক্ষা সফরে যেয়ে অনেক আনন্দ করবো বলে পরিবারকে বুঝিয়ে সম্মতি নিছি। স্যার আর বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তোলার ইচ্ছায় ঘরের স্মার্টফোনটা নিছিলাম। হঠাৎ দেখি গাড়ি থেমে গেছে। গাড়ির ভেতর সবাই বলাবলি করছে, ডাকাত ঢুকছে। তখন ডাকাতরা বাসে উঠে সবার সবকিছু নিচ্ছিল। আমার কাছে ডাকাত এসে চোখ বড় করে বলতে থাকে, মোবাইল দে। তখন ভয়ে শরীর কাঁপছিল। এসময় জোর করে মোবাইল নিয়ে গেছে।’

মনে অইছিন ডাকাতরা মাইরা ফালাইবো, আল্লাহ বাঁচাইছে

এখনো ডাকাতির দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে জানিয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিথিলা আক্তার বলতে থাকে, ‘একেকটা ডাকাত ভয়ানক ভাব লয়্যা বাসে উঠছে। যতক্ষণ বাসে রইছে আতঙ্ক সৃষ্টি কইরা লুটপাট করছে। ডাকাত আমার কাছে আসতেই ভয়ে বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছিল। মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ভয়ে আর তাকানোর সাহস পাইছি না। মুখ নিচু করে বয়্যা রইছি।’

শিক্ষা সফরের ওই বাসে ছিল সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী তৌকির আহমেদ। তার ভাষ্য, ‘অনেকের কাছে ডাকাতদের গল্প হুনছি। এবার নিজর চোখে বাস্তবে ডাকাত দেখলাম। গাড়িতে ডাকাত উঠার সময় কি যে ভয় করছে, বইল্যা বুঝইবার পারতাম না। মনে অইছিন, ডাকাতরা আমরারে মাইরা ফালাইবো। পুরো শরীর তখন ঘাইম্যা গেছে। আল্লাহ বাঁচাইছে।’

ডাকাতদের মারধরের শিকার হয়েছেন বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর সাখাওয়াত হোসাইন রবিন। তিনি বলেন, ‘ডাকাতরা ছাত্রীদের দিকে যাওয়ার সময় বাধা দিয়েছিলাম। এতে আমার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে হাতে থাকা দায়ের উল্টো পিঠ দিয়ে আঘাত করে।’

সোয়াইতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ খলিলুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গজারি বনের ভেতর দিয়ে চলা ঘাটাইল-সাগরদীঘি সড়কের পাশ থেকে একটি গাছ কেটে রাস্তা আটকে দেয় ডাকাতদল। চারটি বাসের প্রথমটিতে ছিলাম আমি। ডাকাতদের সবার হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। এসময় সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। ডাকাতরা শিক্ষক, অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার, ঘড়ি নিয়ে গেছে। চালকদের কাছ থেকেও টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের মারধর করেছে। এ ঘটনায় রাতে থানায় অভিযোগ দিয়েছি। এদের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারলে ডাকাতদের পুরো চক্রকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’

jagonews24

সাগরদীঘি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য লিয়াকত হোসেন বলেন, ঘাটাইল উপজেলা সদর থেকে সাগরদীঘি পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার সড়কে প্রতিনিয়ত ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। গত ১০ দিনে সড়কের একই স্থানে তিনটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশি তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন।

ঘাটাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রকিবুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, যে সড়কটিতে ডাকাতির ঘটনাটি ঘটে, সেখানে গহিন বন। ফলে পুলিশি তৎপরতা চালানো চ্যালেঞ্জিং। বাসে ডাকাতির ঘটনায় পাওয়া অভিযোগটি রাতেই মামলা হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয়েছে। ডাকাতচক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ডাকাতির সময় বাসের ভেতরে থাকা যে কারও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারতো। ভাগ্যগুণে সবাই সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছেন। দূরে কোথাও শিক্ষা সফরে না যাওয়াই ভালো।

এসআর/জিকেএস

Read Entire Article