মরদ: নিজের ভেতর নিজেকে খোঁজা

3 hours ago 2

কথার মধ্যে যে নিবীড়ে টেনে নিয়ে আকুলিত পথে যাত্রা করা হয়েছে, সেখানে মায়া গলে এগিয়ে এসেছে বোধের চকিত নজর আর ভাবের তাপিত হাওয়া। মুহূর্তেই পাঠকের আষ্টেপৃষ্ঠে ছড়িয়ে দিতে পারে ভাষার মনোলোভা সৌন্দর্য চেতনা। ঘটনার সাথে ঘটনার শিল্পিত উপস্থাপনে আশ্চর্য পরিমিতিবোধ; এমনকি ঘটনার শেষ পর্যন্ত একটা বিষয়কে ধারণ ও বিচরণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে, মাধুর্যে বাহিত করতে পারেন; এমন কথাসাহিত্যিকের আজকাল বড় অভাব। আদতে কথাসাহিত্যিকেরা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ক্ষান্ত হন না বরং আঙ্গিকে একটি পরিবেশ পরিস্থিতি ফুটিয়ে তোলেন।

মূলত বিষয়কে পাঠকের সামনে প্রাণবন্ত এক সিনেমার মতো প্রদর্শিত করেন মহিবুল আলম। সম্প্রতি এই কথাসাহিত্যিকের ‘মরদ’ উপন্যাস পাঠ পরবর্তী একজন পাঠক হিসেবে বলতে পারি, আমি তৃপ্ত। সত্যিকার অর্থে, তৃপ্ত হওয়ার পরে একটি ব্যাপারকে বড় পরিসরে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না। তৃপ্ত হওয়ার পরে আর কোনো শব্দ থাকে না একটি ঘটনা কিংবা ক্রিয়াকলাপকে বোঝানোর। ইদানীং সাহিত্য সমাজে সদা অস্থিরতা বিরাজ করছে। যেই লেখা পড়ছি; সেখানের মধ্যে স্থিরতা খুঁজে পাচ্ছি না বললেই চলে। কেননা লেখকের সাথে লেখকের উল্লেখিত ঘটনারও সামান্য সম্পর্ক থাকে না। কেবল আরোপ করে সরাসরি বললে জোরপূর্বক একটা ঘটনা লেখা হয়।

প্রযুক্তি আমাদের লেখালেখির খবরাখবর প্রকাশে সহজতর করে দিয়েছে সত্যি, এক তুড়িতে সেজে যাচ্ছে লেখক। নিবীড় সাধনার সংযোগের ধার ধরছেই না। সব কর্ম সাধনের পরেও তুমি লিখছো বলেই আমাকে লিখতে হবে। তুমি কবি বলে আমাকেও কবি হতে হবে! এ রকম প্রবণতায় নিজেদের লেখা খুঁজে পাচ্ছেন না লেখক সমাজ। লেখালেখিতে ত্যাগের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো লাগে, এটি নিতান্ত শখ আর দেখানোর বিষয় নয়। এসব হাতেগোনা লেখকও মানতে চান না। এ জন্যই এখন যা-কিছু লেখা হচ্ছে; সেসবে অস্থিরতা, কেমন জানি একটি লেখায় শব্দের সাথে পরের শব্দের মিল পর্যন্ত নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু দিয়ে বই ছাপিয়ে দিচ্ছে শখের ঠেলায়; এসব কথা বলার কারণ অনেকদিন পরে একজন কথাসাহিত্যিক মহিবুল আলমের ‘মরদ’ উপন্যাসটি। উপন্যাসে ঘটনার সাথে পরিবেশ পরিস্থিতিতে পাঠক হিসেবে আমাকে সম্পৃক্ত করেছে শব্দ থেকে শব্দে। ‘মরদ’ শুধু উপন্যাস নয়, একটি সময়কেও যথাযথ নির্মাণ। এমনকি সে সময়ের পরিবেশ পরিস্থিতিকে চোখের সামনে প্রদর্শিত করেছে। এ এক জাত কথাশিল্পের প্রতিভার স্ফূরণ।

০২
‘মরদ’ উপন্যাসটি মসজিদের ইমামকে নিয়ে রচিত হয়েছে। ইমামের নাম আসকর আলী মৌলবি। মধ্যপাড়া মসজিদের ইমাম। তাজুল মিয়া সেই মসজিদের মুয়াজ্জিন। মসজিদে আজান দেওয়ার জন্য বেতন দেওয়া হয় না কিন্তু আজান দিতে সময়ের কোনো হেরফের নেই। এ ছাড়া তাজুল মিয়া আসকর আলী মৌলবির পাড় ভক্ত। ভক্ত হবে না কেন! মধ্যপাড়া মসজিদে একজন ইমাম বছরও টেকে না। শুধু আসকর আলী মৌলবি রেকর্ড দশক পার করেছে। এসব সম্ভব হয়েছে আসকর আলী মৌলবির নির্লিপ্ততায়।

পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন পদের মাতব্বরিদের প্যাঁচালেও নিজের মতামত না জানিয়ে চুপ থাকতে পারা। এমনকি নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে চেয়ে থাকে। মেয়ে মানুষ হলে তো কথাই নেই। যে যা বলে চুপচাপ শুনে যায়। নিজের গরজে নিজের ক্ষতির কথাতেও কিছু বলে না। এমনকি ইমামতি করার মসজিদে যে ইসতেসকার নামাজ পড়াতে বড় মসজিদের বড় হুজুর আসবে, এ সিদ্ধান্তেও কথা বলে না। মাতুব্বর, মেম্বারদের সামনে কিন্তু তাজুল মিয়া ঠিকই প্রতিবাদ করে ওঠে ইমামের পক্ষ নিয়ে। ইমামের এমন নির্লিপ্ততায় ভীষণ মন খারাপ করে তাজুল মিয়া। কিন্তু আনু মেম্বার তাজুল মিয়ার এই প্রতিবাদে ইসতেসকার নামাজের পরেও জুমার নামাজ বড় হুজুর পড়াবে এ সিদ্ধান্ত দেয়। এতেও আসকর আলী মৌলবি কিছু বলে না। বার্ষিক মাহফিলে কে এলো, কী করলো এসবেও কোনো শব্দ পর্যন্ত করে না।

কিন্তু একসময় আসকর আলী মৌলবির শরীরি ভাষার তেজ ছিল। যুবক বয়সে প্রথম যেখানে ইমামতি করতো; সেসময় উম্মে কুলসুমের সাথে আনন্দের সংসার পেতেছিল। কিন্তু একদিন একটা কাজে গ্রামের বাইরে যায়। সেইদিন ঘটে ঘটনাটি। তড়িঘড়ি করে কাজ সেরে ফিরেই নিজের চোখে দেখলো ঘটনাটা। নিজের সাধের বউ উম্মে কুলসুমের দেহের ওপর মসজিদ কমিটির সভাপতির কলেজপড়ুয়া ছেলে! সালিশ হলো, সব মেনে নিয়ে আবারও ঘরে তোলার ইচ্ছে পোষণ করে। যদি উম্মে কুলসুম ক্ষমা ও এহেন কর্মকাণ্ড করবে না বলে অঙ্গীকার করে সবার সামনে। কিন্তু উম্মে কুলসুমের ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, অভিযোগ করে আসকর আলী মৌলবির মর্দামি শক্তি নেই। আসকর আলী মৌলবি মরদ নয়!

‘আফজল আলী মেম্বর জিজ্ঞেস করে, ক্যান?
কুলসুম উষ্মা গলায় বলে, তাইনে মরদ নিহি? তাইনে না-মরদ...
মরদ, না-মরদ! আসকর আলী মৌলবি তারপর থেকে এতগুলো বছর ধরে প্রতিনিয়ত নিজের ভেতর নিজেকে খুঁজেছেন কোনো কোনো ভোরে ফজরের নামাজের আগে পুকুরের গলা জলে নিজেকে অসংখ্যবার প্রশ্ন করেছেন, ইয়া মা’বুদ, আমি কি মরদ, নাকি না-মরদ? (৫০ পৃষ্ঠা)

আসকর আলী মৌলবির সাথে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা বুকের ভাষা যেন হারিয়ে দেয়। কথা বলে না, প্রতিবাদ করে না। সংসার হারিয়ে সেই মসজিদ থেকে মধ্যপাড়া মসজিদে এসেই সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে গেছে। বাড়ি তেমন দূরে নয়, তবে যাওয়া-আসা নেই দশক পেরিয়েও। এদিকে মসজিদের কবরস্থানে ঘটতে থাকে অদ্ভুত ঘটনা। তাজুল মিয়া তৈরি করে মিথ। বাঁশঝাড়ে যেই বড় একটা সাপ আছে, সেটি মরদ জিন। সেই জিন মেয়ে মানুষের সদ্য লাশ কবর থেকে তুলে আনে! শুধু যে মেয়ে মানুষের লাশ তোলে, সেজন্য সেই জিন মরদ নিশ্চয়ই! তাজুল মিয়া নিজের মতো কল্পকাহিনি তৈরি করে গ্রামবাসীর কাছে ছড়িয়ে দেয়। উপন্যাসের শুরুতে জয়নালের বউ মাজেদার লাশ কবরস্থ করার পরদিন কবরের ওপর প্রথম দেখে তাজুল মিয়া। এলাকার মানুষদের ডাকে। আবার আসকর আলী মৌলবিকে দিয়ে দোয়া-দরুদ পড়ে কবরস্থ করা হয়।

০৩
উম্মে কুলসুমের সাথে বিচ্ছেদের পরে সেই মসজিদের ইমামতি ছেড়ে মধ্যপাড়া মসজিদে বারো বছর। নিজের বাড়িতে এ সময়ে একবারও যাওয়া হয়নি। শরীয়তী লেবাসে ইমামতি করলেও নিজের ভেতরে বৈরাগ্য। নিজের মা-বাবার জীবনেও আরেক হৃদয়বিদারক ঘটনা। নৈরাশ্যের কথাগুলো মহিবুল আলম এভাবে বললেন, ‘আসকর আলী মৌলবি ভাবলেন, আহা, পুরো বারো বছর ধরে সেই গ্রামে যাওয়া হয় না। তার বাল্যকালের সেই গ্রাম। ছোটবেলায়ই তিনি তার বাবাকে হারান। তার বাবা ময়েজ আলী তোতার বিলেই রাতে মাছ ধরতে গিয়ে ডাকাতের রামদায়ের কোপে মারা যান। তার কল্লাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকালে মানুষজন দেখে, নৌকা একদিকে ভাসছে, কল্লা ছাড়া শরীর অন্যদিকে। পরে তার মার বিয়ে হয় তার ছোট চাচা রমজান আলীর সঙ্গে।...আসকর আলী মৌলবি বড় হয়ে শোনেন, তার ছোট চাচাই নসকি তার মাকে পাওয়ার জন্য তার বাবার কল্লা ফেলে দিয়েছিলেন। তবে এ কথার কোনো প্রমাণ ছিল না। একবার বর্ষাকালে সাত দিন আগে-পরে কলেরায় ছোট চাচা ও তার মা মারা যান। আজকাল কলেরা কোনো রোগ নয়। তারপরও এমন একটা অসুখে তার ছোট চাচা ও তার মা মারা গেলেন কীভাবে? গ্রামের মানুষজন বলতো, ওটা নাকি তার বাবার অভিশাপ ছিল। পাপের ফল নাকি পাপে গোছায়!’ (২৮ পৃষ্ঠা)

মায়ের মৃত্যুর সময় আসকর আলী মৌলবি সবে কিশোর। ছোটকাল থেকে বয়ে বেড়ানো নৈরাশ্য নিজের সংসারে দ্বিগুণ শক্তিতে আঘাত হানে যেন; আপনজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। আর সংসারেও যায়নি। কুলসুমের সেই অভিযোগ আসকর আলী মৌলবি মরদ নাকি মরদ না, এ ভাবনার গোলকধাঁধায়; এ থেকে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, নিজের কোনো অভিযোগে নিস্পৃহ থাকা অভ্যাস হয়ে গেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরে সকালে এলাকার ছেলেমেয়েদের কুরআন শিক্ষায় সময় পার করে দিচ্ছে। পালাক্রমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে আসা। কখনো রাতের খাবার কারও বাড়ি থেকে টিফিনবক্সে করে নিয়ে আসা। এরকম প্রবাসী মিজান মিয়ার বাড়িতে আসা-যাওয়ার প্রেক্ষিতে ঘটনার নতুন মোড় নেয়। মিজান মিয়া সৌদি প্রবাসী। ঘরে কেবল স্ত্রী সেনোয়ারা, ছোট ছেলে। মিজান মিয়ার বাড়িতে গিয়ে মাঝেমধ্যে আসকর আলী মৌলবির দেওয়ালে টানা টেলিভিশনে চোখ যায়, ‘আসকর আলী মৌলবি মিজান মিয়ার বাড়িতে দুপুরে খেতে গিয়ে আড়চোখে বেশ অনেকবারই টেলিভিশন দেখেছে। কী পরিষ্কার টেলিভিশনের ছবিগুলো। মনে হয় যেন জীবন্ত। টেলিভিশন দেখতে দেখতে তিনি ভেবেছেন, মা’বুদের কী কুদরত। ফটোর ফ্রেমের মতো দেখতে, অথচ কী বড় বড় মাথাওয়ালা ছবি!’ (৩০ পৃষ্ঠা)

ইদানীং মিজান মিয়ার বাড়িতে পালায় খেতে গেলে সেনোয়ারার ভাব-গতিক বেশ উস্কানিমূলক; ভাত দিতে এসে, দরোজা খুলে দিতে এসে, আপ্যায়নে বেশ ঝুকে পড়ে যেন; আসকর আলী মৌলবি সেনোয়ারার গরম শ্বাস নিয়ে পীড়নে ভোগে। কল্পনায় জমিয়ে তোলে চাহিদা, অতীতের টানাপোড়েনে কষ্টের পসরা সাজায়। সেনোয়ারার কাছে যাওয়া-আসার মধ্যে পুকুরে রাজহাঁস ভাসতে দেখলেও হারানো কুলসুমের কথা মনে পড়ে; অন্যদিকে সেনোয়ারার শরীরের গরম শ্বাস আসকর আলী মৌলবির ঘুম হারাম করে দেয় যেন, ‘আসকর আলী মৌলবি ভাবলেন, সত্যি মিজান মিয়ার বড় সেনোয়ারা বেগম গাঁয়ের জোয়ান মরদ আর মসজিদের ইমামকে আলাদা করে দেখে না। কী যন্ত্রণা! ঘরের পেছনের ডাহুকের ডাকটা হঠাৎ থেমে গেছে। তবে ঝিঁঝি পোকার ডাক অনবরত আসছে। মনে হয় কাজী বাড়ির কুকুর।

পুব পাড়ার কোনো বাড়ি থেকে একটা গরু ডাকছে হাম্বা-অ-অ-অ। মস্তানের আইল ধরে কেউ গান গেয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই উত্তর পাড়ার কোনো ডাঙর পোলা গোপালপুর থেকে ট্রেন ধরে উপজেলা সদরে গিয়ে সিনেমা দেখে এসেছে। এখন হাঁটতে হাঁটতে সে ওই সিনেমার গান ধরেছে।
আসকর আলী মৌলবি কী ভেবে কয়েক মুহূর্ত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। মাটির কলসটার পাশের টিফিন কেরিয়ারটার দিকে তার চোখ পড়ল। চকচকে স্টিলের ওপর তরকারির ঝোলের সরু রেখা দুটো কেমন মিজান মিয়ার বউয়ের চোখের মতোই চকচক করছে। হারিকেনের আলোটাও যেন স্টেনলেস স্টিলের ওপর পড়ে সেনোয়ারা বেগমের দেহের মতো খলবল করছে।’ (৩৭ পৃষ্ঠা)

একদিন সেনোয়ারা রাতে আসকর আলী মৌলবিকে প্রণয়ের ডাক দিলেন। বহুল আকাঙ্ক্ষিত ডাক। সেদিন মেঘ ভাঙা ঝড়ো বৃষ্টি ঠেলে গিয়েও নিজের মর্দামি শক্তি দেখাতে পারলেন না। সেনোয়ারার বন্ধ দরোজা থেকে ফিরে এসে মসজিদের পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে, ‘আসকর আলী মৌলবি ধপাস করে পুকুরের জলে পড়ে গেলেন। তার শরীর একেবারে নিস্তেজ হয়ে উঠলেও পুকুরের জল বেশ উষ্ণ। প্রকৃতিতে ততক্ষণে তুফানের ধার কমে গিয়ে অঝোর ধারার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টি অনুতপুর, খরমপুর, আব্দুল্লাহপুর, হিরাকান্দা, দিলালপুর বা রসুলপুরের মানুষজনের বহুল প্রতীক্ষার বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে সমস্ত ফসলী জমি খুশিতে উর্বর হয়ে মানুষের মতো অট্টহাসি দিয়ে উঠবে।

কিন্তু আসকর আলী মৌলবির ভেতরের ফসলী জমিতে বরং বিস্তীর্ণ খরার টান। তিনি গলা জলে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কী ভেবে দুই হাতে পুকুরের জল ঠেলে ডুব দিয়ে ভেসে উঠতে উঠতে মধ্যরাতের আর্তনাদ করে উঠলেন, ইয়া মা’বুদ, আমি মরদ, আমি মরদ...!

আসকর আলী মৌলবি কিছুক্ষণ পর টের পেলেন, তার বুক ভেদ করে কী একটা কান্না ডুকরে বের হচ্ছে। একসময় তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। মিহি সুরের কান্না- ইঁ ইঁ, ইঁ ইঁ। (৫৩ পৃষ্ঠা)

০৪
মিজান মিয়ার বউ সেনোয়ারার হঠাৎ মৃত্যু উপন্যাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেনোয়ারার মৃত্যু কী স্বাভাবিক, নাকি আত্মহত্যা। এই নিয়ে রহস্যের দানা বেঁধেছে। মিজান মিয়া বিদেশ থেকে এই মৃত্যুর কারণ বের করে। কবরস্থ করার সিদ্ধান্তে এলাকার মাতব্বর, মেম্বার জল ঘোলা করতে চায়নি। বরং একরকম চাপে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে কবরস্থ করা হয়। সেদিনের রাতে মরদ জিনের আসল রহস্য ফাঁস করে উপন্যাসের লেখক মহিবুল আলম। সেনোয়ারার মরা লাশ কবর থেকে তুলে বিকৃত যৌনচার করা হয়। সেনোয়ারা জীবদ্দশায় নিজ থেকে আহ্বান জানিয়ে রেখেছিল শারীরিক সম্পর্কের। কিন্তু আসকর আলী মৌলবি মরদ নাকি মরদ না, এ দ্বান্দ্বিক সমস্যা নিয়ে এগোতে পারেনি। বরং লাশ নিয়ে বিকৃত মানসিকতা তৈরি হয়েছে মৌলবির। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা ও লাশে আতরের নাক জ্বলা গন্ধে কখন জানি অবসাদে লাশের পাশে ঘুম এসে যায়।

ঘুমন্ত আসকর আলী মৌলবির ওপর শিয়ালের দল হামলে পড়ে। মারাত্মক জখমে গোঙানি দিয়ে আসকর আলী মৌলবি কোনোমতে নিজেকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরের ঘাটলায় এসে ধপাস করে পড়ে; এরপর বেহুঁশ। সকালে আগত মুসল্লিরা আবিষ্কার করে ক্ষতাক্ত মৌলবিকে। তাজুল মিয়া কাহিনি করে মরদ জিন সেদিন সেনোয়ারার লাশ তুলে মৌলবির ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেননা এ কবরস্থানের আশপাশে পাহারাদার কেবল মৌলবি। মরদ জিনের কাজে বাধা দেওয়ার একমাত্র ব্যক্তি আসকর আলী মৌলবি। তাজুল মিয়ার এই চমকপ্রদ কাহিনিও সবাই বিশ্বাস করে নেয়। সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় মৌলবিকে অচেতন অবস্থায়; ট্রেনে করে এলাকার মাতব্বরও ছুটলেন মৌলবিকে নিয়ে। পথের মধ্যে চোখ খুললো। এদের মমতা, বিশ্বাস, ভালোবাসা দেখে চোখ ভিজে এলো। তাজুল মিয়াও কেঁদে উঠলো। সোনা কাজি আশ্বস্থ করলেন, মৌলবি ভালো হয়ে যাবে। মসজিদের পাশে একলা ঘরে আর থাকতে দেবে না মৌলবিকে। চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠবে মৌলবি। কিন্তু এমন দরদমাখা মুখগুলো দেখে শেষ বিদায়ে জৌলুসপূর্ণ হলো যেন আসকর আলী মৌলবির।

‘মরদ’ উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে অন্যরকম সংযোজন বাংলা সাহিত্যে। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মধ্যে রহস্যময় অনুভূতির অনবদ্য দলিল এ উপন্যাস। মহিবুল আলমের ভাষার দক্ষতার চেয়ে বিষয়বৈচিত্র্যে মুগ্ধ করার মতো। ভাষার মধ্যে রিদ্মিক দোল, আন্তরিক বুননকৌশল আর অল্প পরিসরে একটা সময়-অবস্থাকে এত জীবন্ত ছবি আঁকেন মহিবুল আলম। ‘মরদ’ উপন্যাস দিয়ে মহিবুল আলম নিজের অবস্থান তুলে ধরবেন বাংলা সাহিত্যে, এতটুকু বলার দাবি রাখে।

বইয়ের নাম: মরদ
লেখক: মহিবুল আলম
প্রকাশনী: শোভা প্রকাশ
প্রচ্ছদ: হিমেল হক
মূল্য: ১৭৫ টাকা।

এসইউ/এএসএম

Read Entire Article