গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু সংক্রমণ ভুগিয়েছে দেশবাসীকে। প্রাণ যায় প্রায় ছয়শ মানুষের। সিটি করপোরেশনগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার ছিল বেশি। ডেঙ্গুর সংক্রমণ একটু কমতে শুরু করলেই সদর্পে হাজির হয় কিউলেক্স মশা। এই মশার অত্যাচার এত বেড়েছে যে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলছে খোদ সিটি করপোরেশন।
আগে বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে মশার উপদ্রব বেশি থাকতো, এখন তা বছরজুড়ে। দিন যায় কিন্তু মশা কমে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম কখনোই খুব শক্তিশালী ছিল না। অধিকাংশ সময় নগরবাসী ব্যর্থতাই দেখেছে। মশা নিয়ন্ত্রণে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও এর সুফল নগরবাসী পায় না। অনেক কার্যক্রম নিলেও তা কদিন না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। মশার কামড় খাওয়া এবং অসুস্থ হয়ে ভোগাই যেন নগরবাসীর নিয়তি!
নগরবাসীর অভিযোগ, এখন কিউলেক্স মশার উপদ্রবে নাজেহাল নগরবাসী। মশক নিধনে কোনো কাজ করছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। আগে সপ্তাহে একবার মশার ওষুধ ছিটালেও এখন এক মাসেও তাদের দেখা যায় না। ফলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই বাসা-বাড়িতে মশা কামড়ায়। সারাদিন বাসায় কয়েল জ্বালানো বা মশারি টানিয়ে রাখতে হয়।
তবে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির দাবি, মশা নিধনে তারা প্রতিদিনই মশার ওষুধ ছিটান। কিন্তু যে হারে মশার উপদ্রব বাড়ছে, তা নিধনে সিটি করপোরেশনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও তারা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে সারাদেশে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন। বছরজুড়ে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারান ৫৭৫ জন। কিউলেক্স মশায় কামড়ালে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার অবস্থা তৈরি না হলেও এদের বাড়-বাড়ন্ত সহ্য করা কঠিন।
চলতি মাসের শুরু থেকে নগরে কিউলেক্স মশা বাড়ছে। এভাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত মশা বাড়বে। এতে মানুষ অসহ্য হয়ে উঠবে। তাই সিটি করপোরেশনগুলোর উচিত ডেঙ্গুর মতো কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া।- অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার
কিউলেক্স মশার কামড়ে তেমন কোনো রোগ না হলেও তা মারাত্মক বিরক্তিকর বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘চলতি মাসের শুরু থেকে নগরে কিউলেক্স মশা বাড়ছে। এভাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত মশা বাড়বে। এতে মানুষ অসহ্য হয়ে উঠবে। তাই সিটি করপোরেশনগুলোর উচিত ডেঙ্গুর মতো কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া।’
ডিএনসিসি
রাজধানীর ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ড। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে মশা নিধনে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক এবং মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়। এ টাকা দিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
তবে মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নাগরিকরা। মহাখালীর আমতলীর একটি বহুতল ভবনের পঞ্চম তলায় পরিবার নিয়ে বাস করেন বাবর আলী। তিনি পোশাক ব্যবসায়ী। মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) সকাল ৮টায় বাসার সামনে একটি টং দোকানে চা খাচ্ছিলেন বাবর। তার সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন স্থানীয় আরও তিনজন বাসিন্দা। তাদের এ চায়ের আড্ডায় নগরে মশার উপদ্রব নিয়ে আলোচনা চলছিল।
- আরও পড়ুন
- পরিত্যক্ত পণ্য কিনে ডিএনসিসির ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম বন্ধ
- বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বছরজুড়ে ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু
- ঢাকায় ভেঙে পড়েছে মশক নিধন কার্যক্রম, ডেঙ্গুতে বাড়ছে মৃত্যু
- ডিএনসিসির পরিত্যক্ত পণ্য কেনায় ‘গোড়ায় গলদ’
এ সময় আলাপকালে বাবর আলী বলেন, মশার উপদ্রব এতটাই বেড়েছে, পাঁচ তলার ওপরও মশা আসে। বাসায় দিন-রাত মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। বিশেষ করে সন্ধ্যার সময় মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে মশা। এখন সকাল বেলা ফুটপাতের টং দোকানে চা খেতে বসেও মশার উপদ্রবে শান্তি নেই।
ডিএনসিসির মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করে সংস্থাটির স্বাস্থ্য বিভাগ। এই বিভাগ সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত মশক নিধন কার্যক্রম ঠিকমতোই চলছিল। কারণ, ওই সময় সংস্থাটির মেয়র আতিকুল ইসলামের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো ছিল। তাকে মেয়র পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর থেকে ডিএনসিসির মশক নিধন কার্যক্রম ভেঙে পড়ে। এখন যারা মশার ওষুধ ছিটান, তাদের তেমন কোনো জবাবদিহি নেই। ফলে ডেঙ্গুর পর কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
আগে মশা নিধনে জনসচেতনতা তৈরিতে ডিএনসিসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) ও জাতীয় স্কাউট দল। মূলত তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম ও জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করেছে। এছাড়া যেসব ভবনে এডিসের লার্ভা পাওয়া যাচ্ছিল তাদের জরিমানাও করছিলেন ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরিত্যক্ত পণ্য কেনার একটি প্রকল্পও চলমান ছিল। এখন কোনো কর্মসূচিই নেই।
এত কর্মসূচি বা উদ্যোগের পরও ঢাকা শহরে মশার প্রাদুর্ভাব কমেনি না বলে অভিযোগ নাগরিকদের। মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির বাসিন্দা নিজামুল হক বলেন, আগে শুষ্ক মৌসুমে মশার আতঙ্ক ছিল। এখন সারা বছরই এডিস ও কিউলেক্স মশার আতঙ্কে থাকতে হয়। বিশেষত, সন্ধ্যায় দরজা-জানালা বন্ধ রাখলেও মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হতে হয়।
২০২৩ সালের ২৩ জুলাই মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে গবেষণার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছিল ডিএনসিসি। সমঝোতার আওতায় ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কীটনাশকের কার্যকারিতা এবং মশার ঘনত্ব ও প্রজাতি বিশ্ববিদ্যালয়টির ল্যাবে পরীক্ষা করার কথা। আর পরীক্ষার মাধ্যমেই মশা নিধনে কীটনাশক প্রয়োগ ও যে কোনো ডিভাইসের ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল। এখন ওই কার্যক্রম চলছে নামমাত্র।
ডিএসসিসি এডিস ও কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে। তবে এখন কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এজন্য ২৭ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি।-ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিশাত পারভীন।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। যার অধিকাংশই সিটি করপোরেশন পূরণ করেনি। শুধু একটি শর্ত তারা পালন করছে। সেটি হলো, ডিএনসিসির পাঁচটা জোনে শুধু গবেষণা কাজ করা। অর্থাৎ, ওয়ার্ডগুলো মশার লার্ভা কেমন আছে, কোনটাতে বেশি বা কোনটাতে কম, কোন ওয়ার্ডে বেশি ওষুধ ছিটাতে হবে বা কোন ধরনের ওধুষ ছিটাতে হবে তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। প্রতি সপ্তাহে এ রিপোর্ট ডিএনসিসিতে পাঠাচ্ছি। কিন্তু তারা কোনো কাজ করছে কি না, তা জানি না।’
জানতে চাইলে ডিএনসিসির উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. ইমদাদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘মশক নিধনে আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। সোমবার (২০ জানুয়ারি) প্রশাসক সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। সবাইকে মশক নিধনে গুরুত্ব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।’
ডিএসসিসি
ডিএসসিসিতে বরাবরই মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নগরবাসী। কিন্তু এ সেবা কার্যক্রমে তেমন পরিবর্তন হয়নি। তারপরও চলতি অর্থবছর ৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ডিএসসিসি।
নাগরিকদের অভিযোগ, বর্ষা মৌসুমে যখন এডিস মশার উপদ্রবে দিনে হাজারো মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিল, তখনও ডিএসসিসি ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটাতো না। আবার এখন শুষ্ক মৌসুমেও তাদের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ফলে ডিএসসিসির নতুন ওয়ার্ড তথা, জুরাইন, ধনিয়া, শ্যামপুর, মাতুয়াইল, ডেমরা এলাকায় মশার যন্ত্রণায় মানুষ অতিষ্ঠ।
ডেমরার কোনাপাড়ার বাসিন্দা মির্জা গালিব। আলাপকালে তিনি বলেন, ডেমরা থানা এলাকায় হাজারো খাল, বিল, ঝিল, ডোবা, নালা রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব জায়গায় পানি কমে যায়। ফলে এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। এখন সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা বা গলিতে দাঁড়ালে মনে হবে, মশা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। মৌমাছির মতো চারদিক থেকে ঘিরে ধরে।
খিলগাঁওয়ের নন্দিপাড়া এলাকাটি ডিএসসিসির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। নন্দিপাড়ার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, আগে মশক নিধন কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে তদারকি করতেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। ৫ আগস্টের পর ডিএসসিসির সব ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এখন মশার উপদ্রব নিয়ে কারও কোনো জবাবদিহি নেই।
জুরাইন এলাকায় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত মিজানুর রহমান। তিনি সম্প্রতি জাগো নিউজকে বলেন, জুরাইনে মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। এখানে সিটি করপোরেশনের লোকজন তেমন কাজ করে না। মশার উপদ্রবে এ এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ।
তবে নাগরিকদের অভিযোগ অস্বীকার করে ডিএসসিসি এলাকায় সব সময় মশা নিধনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিশাত পারভীন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিএসসিসি এডিস ও কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে। তবে এখন কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এজন্য ২৭ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে একযোগে এই কর্মসূচি পালন করবো। এসময় মশক নিধনে কীটনাশকের পরিমাণ বাড়ানো হবে।’
এমএমএ/এএসএ/এএসএম