মহাসড়কে বর্জ্য ফেলছে রাসিক, মারা যাচ্ছে গাছপালা

12 hours ago 7

রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের নওদাপাড়া থেকে সিটি হাট পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ময়লা ফেলছে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের অপরিশোধিত কঠিন বর্জ্য। রাস্তার দুইপাশে স্তূপাকারে ছড়িয়ে থাকা এই আবর্জনা এখন পুরো এলাকাটিকে এক বিষাক্ত ডাম্পিং জোনে পরিণত হয়েছে। এর ফলে রাস্তার পাশের গাছপালা মারা যাচ্ছে, বাতাস ও মাটি দূষিত হচ্ছে, চারদিকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ ও নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। সিটি করপোরেশনের এসব ময়লার কারণে এরই মধ্যে অন্তত ১২টি গাছ মারা গেছে। এরমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে ৯টি গাছ।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন তথ্য মতে, রাজশাহী শহরে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব ময়লা ফেলার জন্য নগরীর নওদাপাড়ায় রাসিকের ভাগাড়টি ২০০৪ সালে চালু হয়েছিল। দুই দশকের ব্যবহারে এটি এখন ধারণক্ষমতার অনেক বাইরে চলে গেছে। ফলে শহরের মোট বর্জ্যের এক চতুর্থাংশ কোনোভাবেই সংগ্রহ হয় না, পড়ে থাকে খোলা জায়গায়।

আরও পড়ুন:
নির্মল বায়ুর শহর রাজশাহী এখন দূষণের নগরী
রাসিকের দূষণে ধুঁকছে প্রমত্তা বারনই নদী

মহাসড়কে বর্জ্য ফেলছে রাসিক, মারা যাচ্ছে গাছপালা

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনাহীনতা কেবল মহাসড়ক নয়, রাজশাহীর পুরো অঞ্চলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

‘দুর্গন্ধে টিকে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। একে একে রাস্তার পাশের সব গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। তারপরও কষ্ট করেই আমাদের চলাচল করতে হচ্ছে।’

সরেজমিনে ঘুরে দেখো গেছে, রাজশাহী নগরীর আম চত্বর মোড় থেকে একটু এগোলেই শহরের দুই ধারে ফেলা হচ্ছে ময়লা। প্রধান সড়কের দুই পাশে উঁচু করে পড়ে থাকা এসব ময়লা দেখে মনে হচ্ছে কোনো ভাগাড়। দুই পাশেই ময়লা জমে সড়ক যেন পরিণত হয়েছে ময়লার পাহাড়ে। এক সময় ময়লার পাশেই ছিল বড়বড় গাছ। এই গাছগুলো ময়লার কারণেই মারা গেছে। কোনো কোনোটি এখনো দাঁড়িয়ে থাকলেও সেটিও মারা গেছে। আবার কোনো কোনোটি কেটে ফেলা হয়েছে। মহাসড়কের পাশে দেখা গেছে প্লাস্টিক, পলিথিন, গৃহস্থালির বর্জ্য, এমনকি হাসপাতালের বর্জ্যও স্তূপাকারে ফেলা হয়েছে। মাটির রং কালচে হয়ে গেছে, বড় গাছের শিকড় আবর্জনার নিচে চাপা পড়ে পচে গেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, শহরের একমাত্র ল্যান্ডফিল নওদাপাড়া এলাকায় অবস্থিত হলেও সেটি বহু আগেই ধারণক্ষমতা ছাড়িয়েছে। ফলে সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী ট্রাক প্রতিদিনই রাস্তার ধারে ও খোলা জমিতে ময়লা ফেলছে।

মহাসড়কে বর্জ্য ফেলছে রাসিক, মারা যাচ্ছে গাছপালা

মধ্য নওদাপাড়া এলাকার স্কুলশিক্ষক আব্দুল খালেক বলেন, দুর্গন্ধে টিকে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। একে একে রাস্তার পাশের সব গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। তারপরও কষ্ট করেই আমাদের চলাচল করতে হচ্ছে।

পথচারী আবু সাঈদ রনি জানান, মাছি, ধোঁয়া আর দুর্গন্ধে হাঁটা যায় না। আগে যেখানে ছায়া পড়ত, এখন সেখানে শুধু পচা বর্জ্যের গন্ধ। গাছও হারিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন:
রাজশাহী নগরীর ৫৭ শতাংশ বাড়িতে মিলেছে এডিসের লার্ভা
অর্ধেকে নেমেছে পদ্মার আয়তন, শুকিয়ে যাচ্ছে শাখা নদীও

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান সংরক্ষণ কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন বলেন, আমরা সাধারণত মহাসড়কের ধারে বর্জ্য ফেলি না। কিন্তু বর্ষার দিনে ভাগাড় উপচে পড়লে ট্রাক ঢোকানো যায় না, তখন সাময়িকভাবে রাস্তার পাশে ফেলতে হয়।

‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধি অনুযায়ী খোলা জায়গায় পৌর বর্জ্য ফেলা নিষিদ্ধ। সিটি করপোরেশন সীমিত স্থানের অজুহাতে এই আইন ভঙ্গ করছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’

তিনি জানান, কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে নতুন প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

মহাসড়কে বর্জ্য ফেলছে রাসিক, মারা যাচ্ছে গাছপালা

তবে পরিবেশবিদদের অভিযোগ, নতুন ভাগাড়ের অজুহাতে সিটি করপোরেশন বছরের পর বছর একই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, অপরিশোধিত বর্জ্য, বিশেষ করে প্লাস্টিক ও চিকিৎসা বর্জ্য, মাটি ও ভূগর্ভস্থ জলের জন্য মারাত্মক হুমকি। এগুলো থেকে নির্গত ভারী ধাতু ও বিষাক্ত পদার্থ গাছ মেরে ফেলে এবং দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক।

রাবির উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এএইচএম মাহবুবুর রহমান বলেন, রাস্তার পাশে গাছ মারা যাওয়া প্রমাণ করে মাটিতে বিষাক্ত রাসায়নিকের মাত্রা বেড়ে গেছে, যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধি অনুযায়ী খোলা জায়গায় পৌর বর্জ্য ফেলা নিষিদ্ধ। সিটি করপোরেশন সীমিত স্থানের অজুহাতে এই আইন ভঙ্গ করছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

মহাসড়কে বর্জ্য ফেলছে রাসিক, মারা যাচ্ছে গাছপালা

পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয়ের উপ-পরিচালক কবির হোসেন জানান, গত বছর তারা সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়ে মহাসড়কের ধারে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে বলেছিলেন। পরে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও আবার ফেলা শুরু হয়েছে। আমরা বিষয়টি পুনরায় তাদের নজরে আনবো।

রাজশাহী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী বৃক্ষরোপণবিদ মীর মুকুট মো. আবু সাঈদ বলেন, গাছ মারা যাওয়ার বিষয়টি আমরা জানতাম না। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।

এমএন/এএসএম

Read Entire Article