মাটি ও বালুর নিচ থেকে সিলেটের সাদা পাথর থেকে লুট হওয়া আরও ৪৫ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় লুটপাট হয়েছিল যেসব পাথর সমালোচনার পর তা ফেরানো হচ্ছে ভোলাগঞ্জ ও জাফলং পর্যটন স্পটে।
শুক্রবার (১৫ আগস্ট) দিনভর কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এসব পাথর জব্দ করা হয়েছে।
এ নিয়ে গত দুই দিনে প্রায় ১ লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা পাথরের মধ্যে ৫০ শতাংশ পুনরায় সাদা পাথরে ফেলা হয়েছে। বাকিগুলোও প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিদিন যে হারে পাথর লুটে নেওয়া হয়েছিল, ফিরছে তার তুলনায় অতি নগণ্য। তাই দৃষ্টিনন্দন এ পর্যটনকেন্দ্র শিগগিরই আগের রূপে ফিরবে কি না, তা নিয়ে আছে সন্দেহ-সংশয় আর শঙ্কা।
প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২ দিনে প্রায় ১ লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার হয়েছে। এসব পাথর উদ্ধার করে প্রশাসন পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে সাজানোর জন্য চেষ্টা করছে। জেলা প্রশাসন কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় অভিযান চালিয়েছে। এসব উপজেলায় অবৈধভাবে লুট হওয়া পাথর জব্দ করে পুনরায় আগের জায়গায় ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া অবৈধভাবে গড়ে ওঠা পাথর ভাঙার মেশিন বন্ধেও অভিযান চালানো হচ্ছে।
শুক্রবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেট সদর উপজেলার ধুপাগুল ও কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জের ক্রাশার মিলের সামনে আমদানি করা পাথর রাখা ও মিলের পেছনে লুটের পাথর বালু ও মাটি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ দ্রুত পাথর ভেঙে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বুধবার রাতে অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে কোম্পানীগঞ্জ থেকে ধোপাগুল পর্যন্ত অনেক ক্রাশার মিল বন্ধ। জেলার ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটরা কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ক্রাশার মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। অভিযানের কারণে অনেক মিল মালিক ও বালু-পাথর ব্যবসায়ীরা গা-ঢাকা দিয়েছেন।
শুক্রবার রাতে বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার মো. মাসুদ রানা। তিনি বলেন, শুক্রবার কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছে। জব্দ পাথর পুনরায় সাদা পাথরে ফেলা হচ্ছে। বুধবার মধ্য রাত থেকে শুরু করে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছে।
এ দিকে, সাদা পাথর থেকে লুট হওয়া পাথর অভিনব পন্থায় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। শুক্রবার খবর পেয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কলাবাড়ি এলাকায় অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। এ সময় মাটি চাপা অবস্থায় বিপুল পরিমাণ পাথর জব্দ করা হয়েছে। জব্দ করা পাথরের মধ্যে ৭ ট্রাক পাথর সাদা পাথরে পুনরায় ফেলা হয়েছে। আরও আনুমানিক ৫ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছে। সেগুলোও সাদা পাথর পর্যটন এলাকায় পুনরায় ফেলার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
কলাবাড়িতে অভিযান পরিচালনা শেষে সিলেট জেলার আরডিসি মাহমুদ আশিক কবির কালবেলাকে বলেন, কলাবাড়ি এলাকায় ক্রাশার মালিকরা মাটির নিচে পাথর মজুত করে রেখেছেন। সেখান থেকে ৭ ট্রাক সাদা পাথর জিরো পয়েন্টে ফেলা হয়েছে। আরও আনুমানিক ৫ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা অবস্থায় রয়েছে। আগামীকাল শনিবার সেগুলোও সাদা পাথরে ফেলা হবে।
তিনি আরও বলেন, কোম্পানীগঞ্জের শতাধিক স্থানে লুটের পাথর মাটি চাপা রয়েছে- এমন তথ্য তাদের কাছে আছে। এ ছাড়া লুটের পাথর শুধু ক্রাশার মিলেই নয়, কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে, এমনকি রান্নাঘরের পেছনেও লুকানোর চেষ্টা করছে লুটেরা চক্র।
গত বুধবার থেকে সাদা পাথর উদ্ধারে অভিযান শুরু করে যৌথবাহিনী। অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ক্রাশার মিলের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এতে অনেক মিল মালিক ও বালু-পাথর ব্যবসায়ীরা গা-ঢাকা দিয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
সিলেট সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা খোশনূর রুবাইয়াৎ কালবেলাকে বলেন, কিছু মিল মালিক লুট হওয়ার সাদা পাথর বালু ও মাটিচাপা দিয়ে আড়ালের চেষ্টা করছেন বলে শুনেছি। এ ছাড়া বিভিন্ন বাড়িতে পাথর লুকানো হচ্ছে। পাথর উদ্ধার করতে আমাদের ২৪ ঘণ্টা অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী জানান, জাফলংয়ের জিরোপয়েন্ট থেকে কিছু দুষ্কৃতকারী রাতের আঁধারে বৃষ্টির মধ্যে কিছু পাথর সরিয়ে ফেলছিল। আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পদক্ষেপ নেই। এরপর থেকে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ-বিজিবির টহল অব্যাহত আছে। এরই ধারাবাহিকতায় সেখান থেকে যে পাথরগুলো সরানো হয়েছে আমরা সেই পাথরগুলো খুঁজে বের করে সাড়ে ৮ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করেছি। কিন্তু পাথর লুটপাটের সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের এই অভিযান আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ কালবেলাকে বলেন, কোম্পানীগঞ্জ ও ধুপাগুলে বিভিন্ন স্থানে লুটের পাথর মাটিচাপার সংবাদ শুনে আমরা অভিযান চালিয়েছি। পাথর উদ্ধারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কী পরিমাণ পাথর জব্দ করা হয়েছে তা আমরা ২ দিন পর জানাবো।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পটপরিবর্তনের পর থেকেই সাদাপাথর এলাকায় শুরু হয় ব্যাপক লুটপাট। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয়ভাবে সব রাজনৈতিক দলের নেতারা এতে জড়িত ছিলেন। ধলাই নদীর উৎসমুখে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ পাথর দিনের বেলা প্রকাশ্যে নৌকায় করে সরিয়ে নেওয়া হয়। শত শত নৌকা দিয়ে প্রতিদিন পাথর পরিবহন করা হয়েছে, এমনকি নদীতীরের বালিও উত্তোলন করা হয়েছে।