ড. ফোরকান আলী
মাদক দ্রব্যের বেচা-কেনা চলে সীমান্ত এলাকার পয়েন্টে পয়েন্টে। নেশাবস্তুর ব্যবসার কেন্দ্র করে সীমান্ত অঞ্চলে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এ ব্যবসায় সহজেই খুব লাভবান হওয়া যায়। বিধায় এলাকার অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে এই ভয়ংকর কারবারে।
অন্যদিকে প্রকাশিত সংবাদে আরও বলা হয়, মাদক সেবন কেবল কিশোর-তরুণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। স্কুল-কলেজের কোনো কোনো শিক্ষকও নেশার নীল দংশনের শিকার। দেশের মাদক ব্যবসায় সুনির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টে সীমাবদ্ধ না থেকে এইসব পয়েন্ট থেকে মাদক দ্রব্যাদির চালান দেশের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়া বিচিত্র কী। বরং সে আশংকা খুবই প্রবল। বিশ্বজুড়ে মাদক এক বিরাট, যেন অপ্রতিরোধ্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশের শহর ও গ্রামের একশ্রেণীর কিশোর ও যুবকের চরম সর্বনাশ এরই মধ্যে হয়ে গেছে মাদকের ছোবলে।
আশির দশকের আগ পর্যন্ত এই দেশে মদ, গাঁজা, ভাং ইত্যাদি ছাড়া বিশেষ কোনো মাদকদ্রব্যের নাম শোনা যায়নি। আশির দশকে পেথেডিন বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পেইনকিলার ইনজেকশন নিয়ে কারো কারো নেশা করার কথা শোনা যায়। সে সময়ে এই দেশের একজন চিত্রনায়িকা পেথেডিনের নেশায় পড়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন। তার কঙ্কালসার ছবি তখনকার পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পরে অবশ্য ওই নারী নেশার অভিশাপ হতে মুক্তি পেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। অতঃপর দেশে আসে হেরোইন, হাসিস। হেরোইনসেবীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। কে না জানে, যে একবার হেরোইনে আসক্ত হয়েছে, তার পরিণতি নির্ঘাত অকালমৃত্যু। অবশ্য সময়মত চিকিৎসা দেওয়া গেলে হেরোইনের নেশা ত্যাগ করতে পারা অসম্ভব নয়।
আজকাল হেরোইনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও নানা রকমের নেশা। এখন সর্বাধিক প্রচলিত নেশাকর পানীয়টির নাম ফেন্সিডিল। এই ফেন্সিডিল অতীতে ব্যবহৃত হত কাশি প্রশমনের ঔষধরূপে। এখন নেশার সামগ্রী। অবশ্য ফেন্সিডিল এবং সেই ফেন্সিডিল পুরোপুরি এক নয়। বাংলাদেশে ফেন্সিডিল নিষিদ্ধ। তা হলেও নেশাখোরদের জন্য শতসহস্র বোতল ফেন্সিডিল আসছে মাদকের বাজারে। ফেন্সিডিলসহ যাবতীয় নেশাকর দ্রব্য চোরাপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকে সীমান্ত দিয়ে। সে কারণেই সীমান্ত এলাকায় মাদক ব্যবসায় জমজমাট। কেবল টেকনাফ নয়, সীমান্ত এলাকার প্রায় সর্বত্র কমবেশি মাদক দ্রব্যাদির ব্যবসায় রমরমা। সমুদ্রপথেও দেশে অনেক মাদক সামগ্রী আসে বলে অভিযোগ রয়েছে। ইয়াবা, হেরোইন-ফেন্সিডিল ছাড়াও উত্তেজক এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘুমের বড়ি খেয়ে আসক্তদের অনেকে নেশা করে থাকে।
নেশার কবলে পড়ে এরই মধ্যে শহর ও গ্রামে কত জীবন যে ধ্বংস হয়েছে, কত পরিবার যে অশান্তির আগুনে পুড়ে জর্জরিত তার ইয়ত্তা নাই। নেশাখোররা কেবল নিজেদেরই ধ্বংস করে না, তারা সমাজের ভেতরে একাধিক মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে। শহরাঞ্চলে ছিনতাই-রাহাজানির মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সহজেই। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে প্রায়শই ছিনতাই ও চুরি-চামারি করে থাকে। বেশ কিছুদিন আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আই,জি,পি কর্মকর্তা খুন হয়েছেন ছিনতাইকারীদের হাতে। এই খুনের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে যারা ধরা পড়ে তারা হেরোইনসেবী। মরণনেশায় আসক্ত যুবকরা নেশার টাকার জন্য যা খুশি তাই করতে পারে। তাদের বোধ-বিবেচনা নাই, থাকতে পারে না। অপরিণামদর্শিতাই তাদের জন্য স্বাভাবিক।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, নেশাদ্রব্যাদির উপদ্রব দিন দিন এতটাই ব্যাপকতা লাভ করেছে যে, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণীর মধ্যেই এই উপদ্রবের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এমনও দৃষ্টান্ত আছে যে, অবিবেচক পিতা বা মাতা নেশার কবলে পড়ে বিপর্যস্ত আর পরিবারের অন্য সদস্যরা, সন্তান-সন্ততি যাপন করছে দুর্বিষহ জীবন। এহেন সর্বনাশা নেশার ছোবল থেকে কিশোর-যুবক এবং সমাজের অন্যান্য স্তরের আসক্তদের বাঁচাবার জন্য মাদকের ব্যবসায় অবশ্যই রোধ করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি পরিবারের অভিভাবকদের সজাগ হওয়া উচিত মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে। কারণ দেশের অধিকাংশ এলাকায় মাদক বিক্রি চলছে ফেরি করে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে ফেরি করে মাদকদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। এই সর্বনাশা মাদকে ঐ এলাকার প্রায় ঘরে ঘরে আসক্ত রয়েছে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী ও তার পিতা পর্যন্ত সর্বনাশা মাদকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায়নি। মাদক সেবনে মর্মান্তিকভাবে একই পরিবারে পিতা-পুত্র পর্যন্ত মারা গেছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নাজিমউদ্দিন রোডে মাদকের স্পটে গিয়ে বিক্রি ও সেবন করার করুণ দৃশ্য দেখেছেন। এলাকার বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও দোকানদারসহ ২০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে তারা নাজিমউদ্দিন রোডে মাদকের ভয়াবহতার ও বিগত কয়েক বছরে আসক্ত ২৩ জনের করুণ মৃত্যুর তথ্য জানান। ঐ এলাকার ছেলেমেয়েরা জানায়, মাদকের কারণে লেখাপড়া তাদের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই লেখাপড়া বাদ দিয়ে মাদক বেচাকেনায় জড়িয়ে পড়ছে এবং বেশ কয়েকজন স্কুল-কলেজ ছাত্রের হেরোইনে আসক্ত হওয়ার কথা বলতে গিয়ে অভিভাবকরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এলাকাবাসীর প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চানখারপুল মোড় থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে চৌরাস্তায় পর্যন্ত নাজিমউদ্দিন রোডে ২৪ ঘণ্টা ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ মাদক বিক্রি হচ্ছে। এই রোডে দুই পাশের চানখারপুল, তাঁতখানা লেন, নবাববাগিচা, আলী নেকী দেউড়ি লেন (গফোবাড়ি), নিমতলীর ঢাল, হোসনী দালান ও জেলগেটের সামনের এলাকায় মাদক বেচাকেনা হচ্ছে। গলি পথে বেচাকেনার পাশাপাশি সেবন চলছে। অনেক বাসাবাড়ি মাদক সেবনে ভাড়ার জন্য দেওয়া হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা চলে এই সব বাসায় মাদক সেবন ও বেচাকেনা। স্কুল কলেজ ছাত্র-ছাত্রীসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ মাদক বেচাকেনায় জড়িয়ে পড়ছে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা সর্বনাশা মাদকের ছোবলে লেখাপড়া বাদ দিয়ে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এলাকার কতিপয় গডফাদার এই মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
পুলিশ প্রশাসন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা মাদক ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে নিয়মিত পাচ্ছে মোটা অংকের মাসোহারা। এ কারণে ঐ এলাকার গলিপথে মাদক বেচাকেনার হাট বসে। এলাকাবাসীকে দেখানোর উদ্দেশ্যে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা হয়। ঐ সময়েও মাদক বেচাকেনা চলে বলেও এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। গত ৪ বছর সর্বনাশা মাদক সেবনে মৃত্যু বরণকারীদের মধ্যে রয়েছে দেলোরা মিয়া, মো. সিরাজ, মো. জাহাঙ্গীর, মো. রমজান, নাজার, নাজিম ও তার পিতা তারা মিয়া, টেনু, তোতা মিয়া, গিয়াসউদ্দিন, ফজল হক, দরবার মিয়া, এনা উল্লাহ, শাহজাহান, কালাসাব, মো. কামাল ও মো. দিলু। উক্ত এলাকাটি সিটি কর্পোরেশনের ৬৩ ও ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড। এলাকাবাসী এই সর্বনাশা মাদকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। এতে প্রশাসনের টনক নড়েনি। এলাকার স্কুল-কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের উক্ত পরিবেশে লেখাপড়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কলেজসহ কয়েকটি স্কুল এলাকায় রয়েছে।
তবে পুলিশ বলছে তাদের প্রশাসনে কর্মকর্তাদের পরিবর্তন করায় কার্যক্রম কিছুটা মন্থর গতিতে চলছিল। বর্তমানে রাজধানী মাদক প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করেছেন বলে তিনি জানান। আমরা আশাকরি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ আমাদের যুব সমাজকে মাদকের ভয়াল ছোবল থেকে বাচাতে আরো সহায়ক হবে। ছেলেমেয়েদের চাল-চলন, মন-মানসিকতার প্রতি সব সময়ই অভিভাবকদের খেয়াল রাখা কর্তব্য। মোটকথা মাদক প্রতিরোধে সচেতনতা দরকার ঘরে ঘরে, জনে জনে।
লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
কেএসকে/জিকেএস