ড.ফোরকান আলী
মাদকদ্রব্য এখন সর্বত্র। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের এমন কোনো পাড়া-মহল্লা ও গ্রাম নেই যেখানে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ নেশার উপকরণ পাওয়া যাবে না। সারাদেশই এখন মাদকের উপর ভাসছে। এই সর্বনাশা মাদকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র-ছাত্রীরা আসক্ত হচ্ছে ব্যাপকহারে।
পুলিশ, র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে বলা হয়, বর্তমানে মাদকাসক্তদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতি মেধাশূন্য হওয়ার চরম হুমকি দেখা দিয়েছে। বেকারসহ অন্য পেশার চেয়ে মাদকাসক্তদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ব্যাপক। মাদক নিয়ে সরকারের তিন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা হতাশ এবং অভিভাবকগণ উৎকণ্ঠিত। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো স্কুলগামী শিশুরা এই সর্বনাশা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে শিশুদের আসক্ত হওয়ার হার গ্রামাঞ্চলেই বেশি বলে উক্ত তিনটি সংস্থা সূত্রে বলা হয়।
মাদক ব্যবসায়ী কিংবা বিক্রেতারা ভেজাল ও বিষাক্ত মাদকদ্রব্য স্বল্পমূল্যে বিক্রি করছে। ইয়াবা, ফেনসিডিলে মেথিলেটেড স্পিরিট, হেরোইনের পরিবর্তে ব্রাউন সুগার ও কুকুর মারার বিষ বিক্রি করছে। ভেজাল ও বিষাক্ত মাদক আসছে সীমান্তপথে। এই সব বিষাক্ত ও ভেজাল মাদকদ্রব্য সেবনে আসক্তদের মধ্যে মৃত্যু বেড়েছে আশংকাজনক হারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, মাদকদ্রব্য এদেশে উৎপাদন ও তৈরি হয় না; বাইরে থেকে আসে। মাদকদ্রব্য আসার পথ বন্ধ করা হলে দেশের অভ্যন্তরে মাদকদ্রব্য পাওয়া যাবে না। এই পথে সঠিক ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে কেবল দেশে মাদক আসা বন্ধ করা সম্ভব। যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য দেশে আসছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ ও র্যাব মিলে জিরোভাগও উদ্ধার করতে পারছে না। সর্বনাশা মাদক প্রতিরোধে সীমিত জনবল দিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। রাজধানীতে মোবাইল কোর্ট চালু করে মাদকের স্পট ধ্বংস করা হচ্ছে।
রাজধানী ও ঢাকার বাইরে মহানগর, জেলা শহর ও উপজেলা শহরে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজার বেচাকেনা এবং সেবন চলছে প্রকাশ্যে। গ্রামাঞ্চলে হাট-বাজারে ও বাড়ি বাড়িতে মাদক সেবন এবং বেচাকেনা চলছে। অর্ধশতাধিক গ্রামে খোঁজ-খবর নিয়ে এই সর্বনাশা তথ্য পাওয়া যায়। সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্য হলো, জুতার সলিউশন পলিথিনে ঢুকিয়ে শিশুরা নাক দিয়ে গন্ধ নিয়ে নেশা করছে। পলিথিনের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে শিশুরা ব্যাপকহারে নেশা করছে বলে চিকিৎসকরা জানান।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধু রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলায় ১০ সহস্রাধিক তরুণ-তরুণী মাদকাসক্ত। তাদের মধ্যে শিশু ও ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা সর্বাধিক। প্রতি ঘরে ঘরে মাদকাসক্ত রয়েছে। এই উপজেলায় মাদকের হাট রয়েছে। অন্যান্য উপজেলায়ও মাদক সেবন পরিস্থিতি কম নয়। বিভাগীয় শহর, মহানগর ছাড়াও প্রতিটি উপজেলার প্রতিটি গ্রামে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজার বেচাকেনা এবং সেবন চলছে ব্যাপকহারে। তবে হেরোইন ও ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবহার কম। সিলেট শহর ও গ্রামাঞ্চলে ইয়াবা,ফেনসিডিল ও গাঁজা সেবন চলছে আশংকাজনক হারে। হেরোইন ও ইয়াবা ব্যবহার শহরে বেশি। সীমান্ত পথে প্রচুর পরিমাণে ফেনসিডিল আসছে।
বৃহত্তর বরিশাল জেলাসমূহের গ্রামাঞ্চলে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে হাত বাড়ালে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা পাওয়া যাবে না। গ্রামে প্রকাশ্যে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা বেচাকেনা চলছে। তবে হেরোইন ও ইয়াবা ব্যবহার কম। বৃহত্তর রংপুর জেলার এমন কোনো গ্রাম ও হাট-বাজার নেই যেখানে ফেনসিডিল ও গাঁজা নেই। প্রকাশ্যে এই মাদক বেচাকেনা চলছে ব্যাপকহারে। ঘরে ঘরে মাদকসেবী ও বিক্রেতা রয়েছে।
এছাড়া উত্তরাঞ্চলের শহর বন্দর গ্রামে মাদকাসক্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে গত দু/তিন মাসে বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, পাবনা সিরাজগঞ্জ জেলায় বিভিন্ন বয়সের দুই শতাধিক মাদকাসক্ত মারা গেছে। এছাড়া লক্ষাধিক মাদকাসক্ত জীবনী শক্তি হারিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী। এরা সমাজ ও পরিবারের বোঝা হয়ে আছে। চিকিৎসকদের অভিমত, অধিকাংশ মাদকাসক্তের মৃত্যুর মূল কারণ মাদক দ্রব্যের বিষক্রিয়ায়। এছাড়া ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ জাতীয় নেশার ট্যাবলেট, ইনজেকশন গ্রহণে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বন্ধ হয়েও অনেক মাদকাসক্ত মারা যাচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসক বলছেন, পেটের ব্যথা, হার্টের ব্যথা নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে অধিকাংশ মাদকাসক্ত।
মাদক বিরোধী কাজ করছে এমন কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা উত্তরাঞ্চলের শহর বন্দর গ্রামে সাত লাখেরও বেশি মাদকাসক্ত চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ৭০ ভাগই তরুণ ও স্কুল-কলেজের ছাত্র। সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলের সন্তান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য মাদকাসক্ত। ১০ ভাগ শ্রমিক শ্রেণির। ১০ ভাগ নারী মাদকাসক্ত। শিশুরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদক সরবরাহ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত আরও ১০ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। সব জেলা, উপজেলা ও গ্রামে মাদকের একই পরিস্থিতি।
শেরেবাংলানগর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, বিষাক্ত ও ভেজাল মাদকদ্রব্য সেবনে ব্রেনের নার্ভ দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়। ধীরে ধীরে কিডনী ও লিভারসহ দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে যায়। এরপর আসক্তের মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে পড়ে। আসক্তদের মধ্যে শিশু ও ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বাড়ছে ব্যাপকহারে। এটা জাতির জন্য বিপদ সংকেত। সময় থাকতে মাদকের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সব পেশার লোকজনকে জেহাদ ঘোষণা করার আহ্বান জানান তিনি। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জেলা ও মাঠ পর্যায়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় সর্বনাশা মাদকের আগ্রাসন বেড়ে চলছে বলে বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন। মাদক নিয়ে কোনো ধরনের আপোষ নেই। কঠোরহস্তে মাদক বিরোধী কার্যক্রম চালাতে হবে। তাহলে জাতি মাদকের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারবে।
লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
কেএসকে/জিকেএস