মানবিকতা শুধু বড় বড় সংগঠন, আন্তর্জাতিক এনজিও কিংবা কোটি কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মানবিকতা আসলে আমাদের চারপাশেই রয়েছে। হোক সেটা প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজে, ছোট দায়িত্বে, কিংবা কারও কষ্ট লাঘবে।
অনেক সময় আমরা মনে করি মানবিক হতে হলে অবশ্যই কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। অথচ সত্য হলো মানবিক হওয়া শুরু হয় ঘরের ভেতর থেকে, রাস্তায়-ঘাটে কিংবা অপরিচিত মানুষের ক্ষুদ্র চাহিদা পূরণের মধ্য দিয়েই।
আজ (১৯ আগস্ট) বিশ্ব মানবতাবাদ দিবস। এই দিনটি মূলত মানবিক কাজে নিয়োজিত মানুষদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পালিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মানবিকতা কতটা জায়গা করে নিতে পারে?
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আসমা আক্তার, নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া-আসার পথে ফুটপাতের এক বৃদ্ধ অসহায়কে খাবার দিয়ে আসেন। তার ভাষায়, 'আমি কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নই। তবে যখনই কোনো অভুক্ত মানুষকে খেতে দিতে পারি, মনে হয় আমার সামান্য কিছু দিয়ে কারও কষ্ট লাঘব হলো। সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় শান্তি।'
মানবিকতা তাই বড় আয়োজন নয়, বরং মানুষের প্রতি সংবেদনশীল হওয়াই মূল। যেমন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী নয়ন সরকার। তিনি ‘সেইভ ফিউচার বাংলাদেশ’ এর প্রধান সমন্বয়ক এবং পরিবেশ ও জলবায়ু ন্যায়বিচার কর্মী। তার ভাষায়, 'শৈশব থেকেই সমাজসেবার প্রতি টান ছিল। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কষ্ট লাঘব করা এবং মুখে হাসি ফোটানোই আমার আনন্দ।’
‘দুর্যোগ বা সংকটে মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসা, উপকূলের প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা কিংবা পরিবেশ রক্ষা সবই মানবিকতার অংশ। ছোট ছোট পদক্ষেপ মিলেই বড় পরিবর্তন আনে। তাই সবাইকে আহ্বান জানাই, মানবিকতাবোধ জাগিয়ে তুলুন এবং পরিবেশ-প্রকৃতিকে ভালোবাসুন', বলেন তিনি।
অন্যদিকে মানবিকতা শুধু মানুষের প্রতিই সীমাবদ্ধ নয়; প্রকৃতির প্রতিও মানবিক হওয়া জরুরি। মহাখালীর বাসিন্দা অসীম সরকার সেটাই প্রমাণ করেছেন তার উদ্যোগে। তিনি শুধু ছাদবাগানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং শহরের রাস্তায় রাস্তায় লাগিয়েছেন অসংখ্য গাছ। তার ভাষায়, 'শহরের তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে। আমরা যদি প্রতিটি রাস্তায় গাছ লাগাতে পারি তাহলে পরিবেশ কিছুটা হলেও শীতল হবে। সিটি কর্পোরেশনের লাগানো অনেক গাছই অযত্নে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে মহাখালী থেকে গুলশান পর্যন্ত ডিভাইডারে গাছ রোপণ করেছি।’
মানবিকতার আরেকটি দিক হলো সংকটকালে পাশে দাঁড়ানো। মানবিকতা নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবক কোরবান আলী প্রথমে কোনো সংগঠনের সদস্য ছিলেন না। পরে তিনি সহমর্মী কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘পাঁচপীর ব্লাড ডোনার সোসাইটি’।
তিনি বলেন, 'মানুষ স্বভাবতই মানবিক। তবে অনেক সময় আমরা বিপদে পড়লেও সাহায্যের হাত বাড়াই না। হাসপাতালে রক্তের অভাব এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে। তাই আমরা কয়েকজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেছি পাঁচপীর ব্লাড ডোনার সোসাইটি। এখন শুধু নিজের জেলা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে আমরা রক্তের ব্যবস্থা করে দিই। একজন রোগী সুস্থ হয়ে হাসলে সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।'
তাদের কথাগুলোই প্রমাণ করে, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়া ছাড়াই আমরা প্রতিদিন অসংখ্য উপায়ে মানবিক হতে পারি। কোনো দিন সেটা হতে পারে রাস্তায় আহত কুকুরকে পানি দেওয়া, কোনো দিন বন্ধুর দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানো।
বিশ্ব মানবিক দিবসের তাৎপর্যও এখানেই। যারা দুর্যোগে, যুদ্ধে কিংবা অনাহারে বিপন্ন মানুষদের সহায়তা করেন, তারা আসলে আমাদের দেখিয়ে দেন মানবিকতার দিশা। জাতিসংঘ বা রেডক্রসের মতো সংগঠনগুলো বৈশ্বিক পরিসরে কাজ করে। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের স্থানীয়ভাবে, ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে আসাটাও জরুরি।
ঠিক এভাবেই ছোট ছোট মানবিক কাজ একসময় বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের সমাজে অনেক সময় প্রতিযোগিতা, বিভেদ আর স্বার্থপরতা সামনে চলে আসে। অথচ মানবিকতার আসল সৌন্দর্য হলো নিঃস্বার্থ হওয়া। এতে যেমন অন্যের উপকার হয়, তেমনি নিজের ভেতরও এক ধরনের তৃপ্তি কাজ করে।
বিশ্ব মানবতাবাদ দিবসে এ বছর ভাবুন – মানবিকতা কোনো সীমারেখায় বাঁধা নয়। সংগঠন থাকলে সেটা সহায়ক শক্তি হতে পারে, কিন্তু না থাকলেও মানবিক হওয়া সম্ভব। দরকার শুধু ইচ্ছাশক্তি আর মমতার।
মানবিকতা বড় কোনো শব্দ নয়, বরং প্রতিদিনের ছোট ছোট দায়িত্ববোধ। দরজার সামনে ক্ষুধার্ত মানুষকে একবেলা ভাত দেওয়া, বৃদ্ধ প্রতিবেশীর ওষুধ কিনে দেওয়া, কিংবা রাস্তায় পড়ে থাকা আহত পশুকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া এসবই মানবিকতা। তাই প্রশ্নের উত্তর একেবারেই স্পষ্ট --সংগঠন ছাড়া মানবিক হওয়া যায় না, এমন নয়; বরং প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজই মানবিকতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
এএমপি/জেআইএম