মানুষ কর্মেই অমরত্ব লাভ করে

1 month ago 12

পারস্পরিক ভালোবাসা ও প্রেম-প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সুবিবেচনা প্রদর্শন আবশ্যক। আর সুবিবেচনা হচ্ছে, মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে যেন কোনো ভিন্নতা না থাকে। ধর্ম মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে আর মন্দকর্ম থেকে বিরত রাখে। যুগে যুগে নবি-রাসুলগণ উন্নত ও যুগোপযোগী জীবন বিধান নিয়ে এসেছেন। কেননা আল্লাহ কারো ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন না। (সুরা বাকারা, ২৮৬) আল্লাহতায়ালা খুব ভালো করে জানেন, কার সাধ্য কতখানি।

মানব শিশু মানবীয় সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও একমাত্র পরিণত বয়সেই সে এর সমস্ত কিছুর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। তাই বলে এর আগে তাকে দেয়া শিক্ষা তো মূল্যহীন নয়। যেমন আমরা সবাই জানি, পশু জন্ম নিলেই পশু কিন্তু মানুষ জন্ম নিলেই মানুষ নয়, তাকে পুনরায় মানুষ হিসাবে জন্ম নিতে হয়।  মানুষ হতে হয় কর্মসূত্রে। মনুষ্যত্ব এমনিতেই আসে না, মানুষ হওয়ার জন্য মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়।

আজ বিশ্বজুড়ে যে অশান্তি আর নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে এর মূল কারণ হলো মানুষ তার নিজ ধর্মের আদেশ নিষেধ মেনে চলছে না। এছাড়া অধিকাংশ মানুষের কর্ম আজ সঠিক নয়, মুখে বলে একটা আর করে ভিন্ন কিছু। আমরা যদি নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তাহলে আমাদেরকে সর্বপ্রথম আমাদের কর্ম ভালো করতে হবে আর ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার আলোকে নিজেদেরকে পরিচালিত করতে হবে।

মানুষ মরণশীল  কিন্তু কর্ম গুনেই অমরত্ব লাভ করে। এই সংক্ষিপ্ত জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, স্মরণীয় করে রাখতে হলে কল্যাণকর কর্মের কোনো বিকল্প নেই। আর এজন্যই বলা হয় মানুষ বেঁচে থাকে তার আপন কর্মে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় -

"মরণ সাগর পারে, তোমরা অমর, 

 তোমাদের স্মরি

নিখিলে রচিয়া গেলে আপনারই ঘর,

 তোমাদের স্মরি।"

মানুষ যখন মন, মেধা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণতা লাভ করলো, তখনই বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর আল্লাহতায়ালা পরিপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন নাজিল করলেন। বিশ্ব যখন মানুষের হাতের মুঠোয়, তখনই বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ঘটে। মহানবির (সা.) পূর্বের কোনো নবি বিশ্বনবি হওয়ার দাবি করেন নি।

মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের পশুতুল্য মানুষগুলোকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন আর তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রার্থনা করেছেন। হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিঝুম রাতের হৃদয়গ্রাহী দোয়া আর পরিশ্রমের ফলে সেই পশুতুল্য মানুষগুলোকে আল্লাহপাক ফিরিশতায় পরিণত করেছিলেন, আলহামদুলিল্লাহ।

মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে পরিণত করার জন্য এসেছিলেন, তিনি বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এসেছিলেন, যাতে তারা এক জাতিতে পরিণত হয় এবং ধরাপৃষ্ঠে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সকল ধর্মের প্রতি ভালোবাসার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জীবন দ্বারা একথা প্রমাণ করে গিয়েছেন, ধর্মের নামে কোনো অন্যায়-অবিচার নেই। সকল ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো শ্রদ্ধার বস্তু। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং সকল জাতির মাঝে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।

তিনি শিখিয়েছেন ধর্ম স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সেতু বন্ধন সৃষ্টি কারী পথ-নির্দেশনা। ধর্ম মানুষের জন্য বয়ে আনে কল্যাণ। ধর্ম মানুষকে এই শিক্ষা দেয় যে, তার জীবনের উদ্দেশ্য কী, কী তার করণীয় এবং কীভাবে জীবনকে সৌন্দর্য মণ্ডিত করতে পারে।  যুগে যুগে মানুষ যখন অজ্ঞতাকে আলিঙ্গন করে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখনই ধর্ম প্রবর্তক ও সংস্কারকেরা স্রষ্টার পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা ও মুক্তির শাশ্বত উপায় নিয়ে এই ধরাধামে আগমন করে মানব জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। অনেকের ধারণা শাশ্বত, ধর্মের জন্যই পৃথিবীতে রক্তপাত বেশি হচ্ছে অথচ কোনো ধর্মই রক্তপাতের কথা বলেনি বা কোনো ধর্মই চায় না সমাজে অশান্তি বিরাজ করুক। বরং ধর্ম একটা ফলবতী গাছ ধ্বংস করতেও বারণ করে।

ধর্ম মানুষকে স্বীয় প্রবৃত্তি দমন করার মাধ্যমে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছে। ধর্ম মানুষকে মানুষের জন্য শান্তি কামনা করার শিক্ষা দিয়েছে আর ইসলামে পারস্পরিক সালাম বিনিময়ের প্রথা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখনো প্রায় সব ধর্মেই বিভিন্ন ভাবে এই প্রথা প্রচলিত আছে। ধর্ম অস্ত্র-ধারণ করতে বলেছে শুধু আত্মরক্ষার জন্য। আর আত্মরক্ষা করার অধিকার সবারই আছে। তাহলে ধর্মের দোষ হবে কেন?

সর্বদা পরিবর্তনশীল এই ধরাধামে মানুষ যখন স্বীয় সংকীর্ণ স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্ম তখন শিকার হয় অপব্যাখ্যার, ব্যবহৃত হয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে। তখন ধর্ম হয় করো জন্য লাভজনক এবং কারো জন্য স্বপ্ন। ধর্ম যখন ‘লাভজনক’ হয় তখন আমরা সৃষ্টির কল্যাণে কাজ না করে শুধু মোনাজাতে স্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করি; জ্ঞানচর্চা ছেড়ে আমিত্ব ও স্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত হই তখন ধর্ম হয়ে ওঠে কারো নিকট বাহ্যিক আড়ম্বরতা এবং কারো নিকট উপার্জনের উৎস।

ধর্মকে পুঁজি করে অন্যায়ভাবে গ্রামের সহজ সরল মানুষের অর্থ লোপাটের অনেক ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় আর এর মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে আমরা লক্ষ্য করে থাকি। আমরা ব্যাবসাবাণিজ্য, চাকুরি যাই করি না কেন, আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের উপার্জন কতটা হালাল।

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানবগোষ্ঠী! পৃথিবীতে যা আছে তা থেকে হালাল, পবিত্র বস্তু-সামগ্রী ভক্ষণ কর এবং শয়তানের অনুসরণ কর না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৬৮)

আসলে প্রকৃত ধর্ম সত্যিকারের মানুষকে এই পার্থিব জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে অনন্ত জীবনের পথে নিয়ে চলে। দর্শন অথবা বিজ্ঞান এখনো বলতে পারেনা, জীবনাবসানের পর মানুষের আত্মার  প্রকৃত অবস্থা কি হবে? ধর্ম মানুষকে চিরস্থায়ী ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্রষ্টার সাথে সংযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে মানব জীবনকে অর্থবহ ও উচ্চ মর্যাদা দান করে। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়ার রহস্য নিহিত।

একজন মানুষ সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন সে যদি তার ধর্মের পরিপূর্ণ অনুসরণ করে চলে তাহলে পরিবার, সমাজ ও দেশে কোনো ভাবেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে না। এছাড়া সমাজে শান্তি শৃঙ্খলার জন্য চাই সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্ব। কেননা  ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য হলো ধর্ম এবং আল্লাহর তৌহিদ আর একত্ববাদের মূল ভিত্তিস্বরূপ। এটি জীবনের সেই মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গি যা বর্ণ ও বংশমর্যাদার ঊর্ধ্বে, জাতিসত্তা ও দেশত্বের বৈষম্য থেকে মুক্ত আর সম্মান ও মানবতার পতাকাবাহক আর এটিই মূল বিষয়বস্তু যা সমগ্র মানবজাতিকে ধর্ম ও জাতীয়তার ঊর্ধ্বে উঠে একই মালায় গ্রথিত করে।

আজ বিশ্বজুড়ে যে অশান্তি আর নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে এর মূল কারণ হলো মানুষ তার নিজ ধর্মের আদেশ নিষেধ মেনে চলছে না। এছাড়া অধিকাংশ মানুষের কর্ম আজ সঠিক নয়, মুখে বলে একটা আর করে ভিন্ন কিছু। আমরা যদি নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তাহলে আমাদেরকে সর্বপ্রথম আমাদের কর্ম ভালো করতে হবে আর ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার আলোকে নিজেদেরকে পরিচালিত করতে হবে।  তবেই সমাজ ও দেশ হবে শান্তি ও সম্প্রীতির।

আল্লাহপাক আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।

[email protected]

এইচআর/জিকেএস

Read Entire Article