মানুষ যখন দানবের ছায়া

3 months ago 6

ড. আতিয়্যাহ আদলান

আরবি থেকে অনুবাদ: মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান

যখন পৃথিবী উত্তাল, পরিবর্তনের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে—তখন অনেক মানুষ তাদের মানবতা হারিয়ে ফেলছে। তারা সেই ফিতরাহ বা স্বভাবধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে, যা আল্লাহ তাদের অন্তরে গেঁথে দিয়েছিলেন। তারা সেই মানবিক অবস্থান থেকে পশুত্বের স্তরে নেমে যাচ্ছে—বরং কখনো কখনো পশুরও নিচে।

তারা নিজেদের সম্মান বিসর্জন দিয়ে, আল্লাহর দেওয়া প্রতিভা ও মর্যাদা উপেক্ষা করে এমন এক নিম্নস্তরে পৌঁছে যাচ্ছে, যা তাদের সৃষ্টি-উপযোগী নয়।

আল্লাহর কিতাব—কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই চিত্র আঁকা হয়েছে। আসুন, সেই আয়নাতে নিজেকে দেখার চেষ্টা করি।

মানুষের মর্যাদার ভিত্তি: কোরআনের ভাষ্যে

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সম্মানিত করেছেন এবং বহু সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন:

আমি আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি, স্থলে ও জলে তাদের চলাচলের ব্যবস্থা করেছি, উত্তম রিযিক দিয়েছি এবং অনেক সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। (সুরা ইসরা: ৭০)

এই সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি সুরা বাকারায় আরও বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, মানুষকে আল্লাহ দুনিয়ায় প্রতিনিধি (খলিফা) হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, তার সৃষ্টিজগতের সমস্ত কিছু মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন:

তিনিই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর সবকিছু, তারপর আকাশের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাদের সাত আকাশরূপে সুসজ্জিত করেছেন, আর তিনি সব বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। (সুরা বাকারা: ২৯)

ফেরেশতারা যখন বিস্ময় প্রকাশ করেছিল যে, মানুষ কি দুনিয়ায় রক্তপাত করবে না? তখন আল্লাহ বলেন:

আমি জানি, তোমরা যা জানো না। (সুরা বাকারা: ৩০)

আদমকে শিখানো হয়েছিল সমস্ত নাম, এমন জ্ঞান যা ফেরেশতাদেরও ছিল না। আর এই জ্ঞানের কারণে ফেরেশতাদের আদমের সামনে সিজদা করতে আদেশ করা হয়—সম্মানের নিদর্শনস্বরূপ।

মানুষের মর্যাদা ও আত্মিক গঠন

আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সুষম, ভারসাম্যপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ গঠনে:

ত্বীন, জয়তুন, সিনাই পর্বত এবং এই নিরাপদ নগরীর শপথ, নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রেষ্ঠতম গঠনে। (সুরা ত্বীন: ১–৪)

আরেক জায়গায় আল্লাহ বলেন:

হে মানুষ! কীসে তোমাকে তোমার উদার প্রভুর ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলেছে? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, গঠন দিয়েছেন, সাম্য এনেছেন, যেভাবে ইচ্ছা তেমন রূপ দিয়েছেন? (সুরা ইনফিতার: ৬–৮)

আল্লাহ তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে বের করেছেন, তখন তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের দিয়েছেন শ্রবণ, দৃষ্টি ও হৃদয়—যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও। (সুরা আন-নাহল: ৭৮)

এ ছাড়া, মানুষের মাঝে লজ্জাবোধ, পর্দা ও আত্মমর্যাদা—এসব গুণ তিনি স্বভাবজাতভাবে সৃষ্টি করেছেন:

হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য পোশাক সৃষ্টি করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকে এবং সৌন্দর্যও জোগায়; আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম। (সুরা আ’রাফ: ২৬)

এগুলো সেই স্বভাবধর্মের (ফিতরাহ) অংশ, যা আল্লাহ মানুষকে দিয়েছিলেন:

তুমি মুখ ফেরাও আল্লাহর দিকে, সরল-স্বভাবধর্মে; এটাই আল্লাহর সৃষ্টি, যার ওপর তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই সত্য ধর্ম, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। (সুরা রূম: ৩০)

তবুও মানুষ কীভাবে পশুতে পরিণত হয়?

যে মানুষকে আল্লাহ সম্মান দিয়েছেন, যাকে এমন সব গুণে ভূষিত করেছেন যা অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেননি—সে-ই মানুষ কখনো নিজের সম্মান বিসর্জন দিয়ে নিজেকে পশুর চেয়েও নীচু করে ফেলে।

সত্য-মিথ্যার সংঘাতে, সংঘর্ষের শিখরে পৌঁছে, মানুষ তার মানবতাকে হারিয়ে ফেলে। সে হয়ে ওঠে এমন হিংস্র, যা এমনকি হিংস্র জানোয়ারদের মধ্যেও বিরল। পশুরা শিকার করে বেঁচে থাকার তাগিদে; কিন্তু এই মানুষেরা পাশবিকতা উপভোগ করে। তারা রক্তপাত করে, অত্যাচার করে, লুট করে—সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো—এগুলোতে তারা আনন্দ পায়।

তারা হয়ত বাহ্যিকভাবে মানুষ, কিন্তু অন্তরে পশুর চেয়েও অধম।

কুরআনের বর্ণনায় মানুষ কীভাবে পশুতে পরিণত হয়

আল্লাহ বলেন:

তুমি তাদেরকে সেই ব্যক্তির কাহিনি শোনাও, যাকে আমি দিয়েছিলাম আমার নিদর্শন। অথচ সে তা থেকে বিচ্যুত হয়েছিল। ফলে শয়তান তার অনুসরণ করল এবং সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। আমি চাইলে, আমি তাকে সেই নিদর্শনের মাধ্যমে মর্যাদাশীল করতাম। কিন্তু সে তো মাটি আঁকড়ে ধরেছিল এবং নিজের খেয়ালখুশির অনুসরণ করেছিল। তার উপমা কুকুরের মতো—তুমি যদি তাকে তাড়াও, সে হাঁপায়; না তাড়ালেও হাঁপায়। এটাই তাদের উপমা, যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে। তুমি কাহিনি বলো, যেন তারা চিন্তা করে। (সুরা আ’রাফ: ১৭৫–১৭৬)

আরও বলেন:

আমি জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি বহু জিন ও মানুষ—তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দিয়ে বুঝে না; চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে দেখে না; কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে শোনে না। তারা পশুর মতো—বরং তার চেয়েও পথভ্রষ্ট। তারাই গাফেল। (সুরা আ’রাফ: ১৭৯)

এসব মানুষ, যারা আল্লাহর নিদর্শন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা এমন হয়ে পড়ে, যেন কেউ নিজের চামড়া ছিঁড়ে ফেলেছে—আত্মার আবরণ হারিয়েছে। তাদের হৃদয় আর কোরআনের আয়াতের প্রতি সংবেদনশীল নয়; তাদের চোখ আর আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্যে আবিষ্ট হয় না।

সুরা ত্বীন: মানবতার সামগ্রিক ব্যাখ্যা

ত্বীন ও জয়তুনের শপথ, সিনাই পর্বতের শপথ, এবং এই নিরাপদ নগরীর (মক্কা) শপথ—নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রেষ্ঠতম গঠনে সৃষ্টি করেছি। তারপর আমি তাকে নামিয়ে দিয়েছি সবচেয়ে নীচু স্তরে—তবে তারা নয়, যারা ইমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে; তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার। (সুরা ত্বীন: ১–৬)

এই সুরায় আল্লাহ কসম খেয়েছেন সেই জায়গাগুলোর, যেখান থেকে তাঁর শেষ যুগের রিসালাত এসেছে—শাম ও ফিলিস্তিন (ত্বীন ও জয়তুন), সিনাই, এবং মক্কা। বলেছেন, তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সবচেয়ে সুন্দর গঠনে, বাহ্যিক ও অন্তরগতভাবে। কিন্তু যারা আল্লাহর পথ ছেড়ে দেয়, তারা পশুর স্তরে নেমে পড়ে। আর যারা ইমান ধরে রাখে, সৎকর্ম করে—তারা তাদের স্বাভাবিক ফিতরাহ ধরে রাখে। তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।

অর্থাৎ মানবতা কেবল একটি পরিচয় নয়—এটি একটি দায়িত্ব, একটি আমানত। যখন মানুষ সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন সে কেবল দুনিয়ায়ই অধঃপতিত হয় না, আখেরাতেও ধ্বংসের পথে যায়।

সত্য হলো—মানবতা হারিয়ে মানুষ টিকে থাকতে পারে না। মানবতা থাকলেই সে মানুষ। তা না হলে, সে কেবল এক দানবের ছায়ামাত্র।

ওএফএফ/এমএস

Read Entire Article