সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমেরিকার রাজনীতি পর্যবেক্ষণকারীরা অসংখ্য ভুয়া দাবি লক্ষ্য করেছেন। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) গাজা উপত্যকায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের কনডম পাঠিয়েছে; লক্ষাধিক মৃত ব্যক্তির নামে এখনো সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা দেওয়া হচ্ছে; কিংবা দুর্যোগ তহবিল ব্যবহার করে নিউইয়র্ক শহরের বিলাসবহুল হোটেলে অভিবাসীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও এসব দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, তবু অনেকেই তা বিশ্বাস করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ ও রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে সত্য ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য বোঝা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
ভুল তথ্য দূর করতে এআই?
ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির গবেষক কার্ট ব্র্যাডকের মতে, ভুল তথ্য দূর করতে বিতর্ক বা তর্ক খুব একটা কার্যকর হয় না। বরং অনেক সময় এগুলো উল্টো প্রভাব ফেলে এবং মানুষের বিশ্বাস আরও দৃঢ় করে। তবে নতুন এক গবেষণা দেখিয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেল—বিশেষ করে জেনারেটিভ এআই—ব্যক্তিকে ভুল তথ্য থেকে দূরে রাখতে তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকর হতে পারে।
আরও পড়ুন>>
- প্রথম ভাষণেই ভুল তথ্য দিলেন ট্রাম্প
- ট্রাম্পের ভয়েই ফ্যাক্ট-চেকিং থেকে জাকারবার্গের ইউটার্ন?
- বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্যের বন্যা ভারতীয় মিডিয়ায়
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এআইটি)-এর গবেষক থমাস কস্টেলো এবং তার সহকর্মীরা একটি গবেষণা পরিচালনা করেন, যেখানে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী ২ হাজার ১৯০ জন ব্যক্তিকে ওপেনএআই’র জিপিটি-৪ (চ্যাটজিপিটি) মডেলের সঙ্গে আলোচনা করতে দেওয়া হয়। তিনটি সংলাপ পর্বের পর দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীদের বিশ্বাসের দৃঢ়তা ২০ শতাংশ কমেছে এবং চারজনের মধ্যে একজন সম্পূর্ণভাবে তাদের ভুল বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছেন।
কেন এআই কার্যকর?
ড. কস্টেলোর মতে, এআই কার্যকর কারণ এটি যুক্তির ওপর ভিত্তি করে উত্তর দেয়, যেখানে মানুষ অনেক সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। এছাড়া, এআই মডেল বিশাল তথ্যভাণ্ডার থেকে নির্ভুল তথ্য উপস্থাপন করতে পারে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিশ্বাসযোগ্যতা। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন একজন ব্যক্তি অন্য কারও ভুল ধারণা সংশোধন করতে যান, তখন ভুল বিশ্বাসীরা সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং মনে করেন, সংশোধনকারী ব্যক্তি কোনো গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ নিয়ে বিতর্কে একজন রিপাবলিকান হয়তো বলবেন, ‘অবশ্যই ডেমোক্র্যাটরা কারচুপির অভিযোগ অস্বীকার করবে, কারণ তারা বিজয়ী।’
তবে এআই’কে নিরপেক্ষ ও তথ্যভিত্তিক মনে হতে পারে, যা মানুষকে ভুল তথ্য থেকে বের করে আনতে সহায়ক হতে পারে।
ভুল বিশ্বাস ঠেকাতে প্রিবাঙ্কিং
কিছু মানুষ এআই’র সঙ্গে বিতর্কে আগ্রহী না-ও হতে পারে। তাই ভুল তথ্য প্রতিরোধের জন্য আরেকটি কৌশল হলো ‘প্রিবাঙ্কিং’ বা আগেভাগে সচেতন করা। ১৯৬০-এর দশকে মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম ম্যাকগুইর এটি ‘অ্যাটিচিউডাল ইনোকুলেশন’ নামে পরিচিত করেছিলেন। এই কৌশলে প্রথমে মানুষকে জানানো হয়, সমাজে ভুল তথ্য ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রয়েছে। এরপর নির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে তা চেনার উপায় শেখানো হয়।
গবেষক ব্র্যাডকের মতে, আগে থেকেই ভুল তথ্য চিনতে পারলে, মানুষ পরবর্তীতে এসব মিথ্যা প্রচারণার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
আরও কিছু কৌশল
ভুল তথ্য প্রতিরোধে আরও কিছু কৌশল ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের গবেষকদের মতে, টিকটকে ভুল তথ্য সংশোধনের ভিডিওতে উচ্চ গতির সংগীত যোগ করলে তা বেশি কার্যকর হয়। কারণ, সংগীত মানুষের মস্তিষ্কে দ্রুত প্রভাব ফেলে এবং ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে যুক্তি খুঁজতে ব্যর্থ করে।
এছাড়া, শক্তিশালী গল্প বলার মাধ্যমে ভুল তথ্য প্রতিরোধের কৌশলও কাজ করে। যেমন, কোনো নির্দিষ্ট চরিত্র ও দৃশ্যের বর্ণনা সংযোজন করলে তা দর্শকের মস্তিষ্কে সহজে গেঁথে যায়, যা ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে।
তবে, এসব কৌশল যেমন সত্য প্রচারের জন্য ব্যবহার করা যায়, তেমনই মিথ্যা ছড়ানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো সমালোচনামূলক চিন্তাধারা শেখানো। ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রমাণ বিশ্লেষণের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে ভিনগ্রহের প্রাণী বা ভুয়া স্বাস্থ্যতত্ত্বে বিশ্বাস করা কমানো সম্ভব।
বিশ্বাস বদলানোর সীমাবদ্ধতা
ইউনিভার্সিটি অব হাডার্সফিল্ডের মনোবিজ্ঞানী জন সিনটের মতে, যত গবেষণাই করা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত একজন ব্যক্তিই ঠিক করেন তিনি কোন তথ্য বিশ্বাস করবেন। তাই ভুল তথ্য প্রতিরোধের প্রচেষ্টা যতটুকু সম্ভব মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত।
কেএএ/