মানুষের পকেট ছোট হয়ে আসছে, বাড়ছে দারিদ্র্য

আমাদের দারিদ্র্য পরিস্থিতি বুঝতে এখন আর বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের দরকার হয় না। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসার টানতে গিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দারিদ্র্য কেন ও কীভাবে হানা দিচ্ছে সংসারে। আয়-ব্যয়ের তারতম্য ক্রমশ বাড়ছে। হাজার টাকার একখানা নোট ভাঙানো মাত্র খরচ হয়ে যাচ্ছে। বাজারে গিয়ে ৪/৫ সওদা অল্প করে কিনলেও হাজার টাকা শেষ। এর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় রীতিমতো শূন্যের কোটায় চলে গেছে। এই বাস্তব পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাংক বলেছে দেশে চার বছর ধরে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। সংস্থাটির অনুমিত হিসাব, ২০২৫ সালে দারিদ্র্যের হার হতে পারে ২১ শতাংশের কিছু বেশি। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ।  ২০২৫ সালে দেশের সার্বিক দারিদ্র্য বেড়ে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে (পিপিআরসি)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ করেছিল ২০২২ সালে। দেশে দারিদ্র্যের হার হিসাব করে বিবিএস বলেছে, তখন সার্বিক দারিদ্র্য হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকে। তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো বিভিন্ন আঘাতের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়

মানুষের পকেট ছোট হয়ে আসছে, বাড়ছে দারিদ্র্য

আমাদের দারিদ্র্য পরিস্থিতি বুঝতে এখন আর বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের দরকার হয় না। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসার টানতে গিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দারিদ্র্য কেন ও কীভাবে হানা দিচ্ছে সংসারে। আয়-ব্যয়ের তারতম্য ক্রমশ বাড়ছে। হাজার টাকার একখানা নোট ভাঙানো মাত্র খরচ হয়ে যাচ্ছে। বাজারে গিয়ে ৪/৫ সওদা অল্প করে কিনলেও হাজার টাকা শেষ। এর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় রীতিমতো শূন্যের কোটায় চলে গেছে।

এই বাস্তব পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাংক বলেছে দেশে চার বছর ধরে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। সংস্থাটির অনুমিত হিসাব, ২০২৫ সালে দারিদ্র্যের হার হতে পারে ২১ শতাংশের কিছু বেশি। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ।  ২০২৫ সালে দেশের সার্বিক দারিদ্র্য বেড়ে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে (পিপিআরসি)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ করেছিল ২০২২ সালে। দেশে দারিদ্র্যের হার হিসাব করে বিবিএস বলেছে, তখন সার্বিক দারিদ্র্য হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকে। তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো বিভিন্ন আঘাতের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। অর্থনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের কারণে এই ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন। এই মানুষগুলোর আয় বাড়ে না, কিন্তু ব্যয় বেড়ে যায় বহুগুণ। সংসারের দৈনন্দিন খাদ্য ব্যয়, বাসাভাড়া-বিল, সন্তানের পড়াশোনা, চিকিৎসা, অতিথি আপ্যায়ন, সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদি ব্যয় কোনো হিসাব মানে না। কোনোভাবেই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

ধরে নেই রাজধানীতে একজন চাকরিজীবীর বেতন ৪০ হাজার টাকা। এই বাজারে সংসার খরচ কমানোর জন্য তার পরিবারে ৩ দিনের বদলে ১ দিন মাছ-মুরগি খাওয়া হচ্ছে, দুইপদ সবজি রান্না না করে একপদ রান্না করছে। সপ্তাহের ডিম বরাদ্দ, চা-নাস্তা, বাচ্চাদের শখের খাবার সব কমিয়ে আনা হলো। কাপড়-চোপড় কেনার কথা হিসেবে ধরাই হলো না, তাও দেখা যাবে সংসারে টানাপড়েন কমছে না, বরং বাড়ছে।

কারণটা খুব সহজ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আগে যে টাকা খরচ হতো, সংসার খরচ বহুগুণ কমিয়েও তার চাইতেও বেশি খরচ হচ্ছে। এছাড়া একইসাথে বাড়িভাড়া, বিভিন্ন বিল, যানবাহনের ভাড়া, পড়ার খরচ সব বাড়ছে। এই মানুষগুলোর পক্ষে ঢাকায় বা শহরে থাকাটা দিন দিন চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। অনেকেই ইতোমধ্যে গ্রামে ফিরে গেছেন, অনেকে পরিবার-পরিজনকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর পাশাপাশি বাড়ছে বিষণ্নতা, হতাশা ও ক্ষোভ। মানুষের আয় কমে গেলে তার পুরো পরিবার বিপর্যস্ত বোধ করে। এরই প্রকাশ দেখতে পারছি চারিদিকে।

নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ও বহু পুরোনো প্রতিষ্ঠান গত দেড় বছরে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গেছে। অনেক কল-কারখানা ঠিকমতো বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে না পারায় বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ। কল-কারখানা ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে। বিশ্ববাজারে অভিবাসী শ্রমিকদের টিকে থাকার অবস্থাও বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে।

তবে এই সংকট হঠাৎ করে শুরু হয়নি, ইদানীং সংকট বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ সার্জিও অলিভিয়েরা বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। রিপোর্টে দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মোটাদাগে যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া, চাকরি হারানো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মজুরি সেভাবে বৃদ্ধি না পাওয়া ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ২০ লাখ কর্মসংস্থান কম হয়েছে। ২০২৫ সালে আরও ৮ লাখ কর্মসংস্থান কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চাকরির বাজার সংকুচিত হওয়ার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি পড়েছে নারী ও তরুণদের ওপর।

বাংলাদেশে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য কমতে শুরু করে। ২০০০ সালের পর থেকে তা আরও গতি পায়। বাংলাদেশ দারিদ্র্য কমানোর গতি ইতিবাচক হলেও, দেখা যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ নানা কারণে পেছন দিকে হাঁটছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসিও মনে করে, ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল দারিদ্রের চিত্র দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘উল্টো ঘুরে যাওয়ার’ সময়কাল। বিশ্বব্যাংকও মনে করে এটি কোনো আকস্মিক পতন নয়, বাস্তবতা এটাই যে দারিদ্র্য বেড়েছে।

আমরা যারা অর্থনীতির সামগ্রিক দিক কম বুঝি, কিন্তু নিজেদের পকেটে চাপ উপলব্ধি করছি, তারা বুঝতে পারছি বেকারত্ব বাড়ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে, কিশোর গ্যাংসহ মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। এরকম একটি সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে যখন দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা জড়িত হয়, তখনই সবকিছু ঝিমিয়ে পড়ে। প্রকাশিত হওয়ার পথ না পায়, বাড়তে থাকে গুপ্ত পথে অপরাধ ও অরাজকতা। 

এই পরিস্থিতিতে রাজনীতি, নির্বাচন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পারিবারিক ব্যয় বৃদ্ধি এসব নিয়ে যাদের সবচাইতে বেশি উত্তেজনা ও প্রতিবাদ জানানোর কথা, তারাই এখন সবচেয়ে নীরব। কারণ সেই সাধারণ মানুষ নিজেদের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। আজকাল মানুষের এমন অবস্থা হয়েছে যে, রাত-দিন মাথায় বাজারের ফর্দ, দ্রব্যমূল্য ও পরিবারে অর্থের জোগান এসবই ঘুরপাক খাচ্ছে। সেইসাথে ভাবছেন কর্মসংস্থানের দিকটিও। কাজ হারানোর ভয়ের পাশাপাশি নিত্যপণ্যের বাজারের চড়ামূল্য সাধারণ মানুষকে অস্থির ও একই সাথে অসহায় করে তুলেছে।

মানুষ সবচাইতে বেশি বিপন্নবোধ করেন খাদ্যের দাম বেড়ে গেলে। কারণ অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, খাবার কিনতেই আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করেন গড়পড়তা মানুষ। গরিব মানুষকে খাবার কিনতে আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত খরচ করতে হয়। ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সঙ্গতি না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী খাবার কিনতে সাধারণ মানুষের সমস্যা হয়।

অর্থনীতিবিদদের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়ায় সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে টানা তিন বছর ১০ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বাজারে জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। দারিদ্র্য কমার পরিবর্তে তা বেড়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের মতো সরকারেরও খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু আয় ততটা বাড়ছে না। সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা, সুদ পরিশোধ, ভর্তুকিতেই বাজেটের সিংহভাগ টাকা খরচ হয়ে যায়। অন্যদিকে নির্বাচন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহী হচ্ছেন না।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। তিনি বলেছেন, সম্প্রতি একটি বড় ভূমিকম্প দেখেছে দেশ। এটা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। কিন্তু এর চেয়ে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। সেটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকম্প। তিনি বলেছেন, ব্যাংক খাতের গোপন খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি, পুঁজি ঘাটতি-সব সংকট একে একে সামনে আসছে। বিনিয়োগ স্থবির, নীতিগত স্বচ্ছতা কম এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার না থাকায় অর্থনীতি চাপে রয়েছে। (ব্যাংকের) শরীরে যে এত রোগ তা আগে জানা-ই যায়নি।

এই বাস্তবতা তুলে ধরে দেশের নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ও সংস্কারহীনতার সমালোচনা করেন তিনি। একসঙ্গে ধরা পড়া এসব দুর্বলতা বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। ড. দেবপ্রিয়র অভিযোগ, প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া হঠাৎ বিদেশি বিনিয়োগের ঘোষণা দেওয়া ও নীতিগত অস্পষ্টতা বিনিয়োগ পরিবেশ আরও দুর্বল করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতির পথ রুদ্ধ করছে। একই সঙ্গে সংস্কার ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আনা স্বপ্নের মতো বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

আমরা যারা অর্থনীতির সামগ্রিক দিক কম বুঝি, কিন্তু নিজেদের পকেটে চাপ উপলব্ধি করছি, তারা বুঝতে পারছি বেকারত্ব বাড়ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে, কিশোর গ্যাংসহ মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। এরকম একটি সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে যখন দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা জড়িত হয়, তখনই সবকিছু ঝিমিয়ে পড়ে। প্রকাশিত হওয়ার পথ না পায়, বাড়তে থাকে গুপ্ত পথে অপরাধ ও অরাজকতা। 

এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় চিহ্নিত করে যতো দ্রুত বেরিয়ে আসা যায়, ততোই মঙ্গল। নির্বাচিত সরকার এলে বিনিয়োগ আসবে, এমনটাই আশা জনগণের। দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তারা যখনই নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার পরিবেশ পাবেন তখনই বিনিয়োগে মনোযোগী হবেন।

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow