মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীদের ফের পাঠানো নিয়ে শঙ্কা, বাড়ছে খরচ

5 hours ago 5

 

সিন্ডিকেট ও অসাধু এজেন্সির চক্করে পড়ে গত বছর মালয়েশিয়া যেতে না পারা ১৭ হাজার শ্রমিকের মধ্যে প্রথম ধাপে নেওয়ার জন্য প্রায় ৮ হাজার জনকে বাছাই করেছে দেশটি। তবে নির্ধারিত সময় চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের পাঠানো নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ নিয়োগদাতা থেকে এখনো কোনো চাহিদাপত্র পাঠানো হয়নি। সেই সঙ্গে খরচ বাড়ায় আগ্রহীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

মালয়েশিয়া জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে যোগ্য হিসেবে নির্বাচন করা ৭ হাজার ৮৬৯ জনকে নির্মাণ ও পর্যটনখাতে নেওয়া হবে। তারা যাবেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিডেটের (বোয়েসেল) মাধ্যমে।

বোয়েসেল সূত্রে জানা গেছে, কর্মীদের পাঠানোর প্রক্রিয়া তারা এরই মধ্যে শুরু করেছে। সবাইকে মোবাইল ফোনে বার্তা দেওয়া ও কল করা হয়েছে। আগ্রহীদের পাসপোর্টের কপি ও মালয়েশিয়ান নির্মাণশিল্প উন্নয়ন বোর্ডের (সিআইডিবি) নির্ধারিত আবেদন ফরম পূরণ করে বোয়েসেলে ইমেইল করতে বলা হয়েছে। সিআইডিবির প্রশিক্ষণ ও সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য কর্মীকে চূড়ান্ত করা হবে।

তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্রের একটিও এখনো আসেনি। ফলে চাহিদাপত্র আনা, প্রশিক্ষণ পরবর্তী সাক্ষাৎকার, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ফ্লাইটসহ নানা প্রক্রিয়া আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলো কর্মী নিয়োগের বিনিময়ে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পায়। এখন সরকারি এজেন্সি বোয়েসেল থেকে অর্থ না পাওয়ায় তাদের লোক নিতে গড়িমসি করার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে দুই দেশের অসাধু লোকজনের যোগসাজশে গঠিত সিন্ডিকেটও এখানে উদ্বেগ তৈরি করছে।

সাধারণত মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলো কর্মী নিয়োগের বিনিময়ে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পায়। এখন সরকারি এজেন্সি বোয়েসেল থেকে অর্থ না পাওয়ায় তাদের লোক নিতে গড়িমসি করার আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে বোয়েসেলের নির্বাহী পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. শওকত আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর তালিকাভুক্ত যে ১০০ এজেন্সি রয়েছে বাংলাদেশে, তারা চাচ্ছে না আমরা কর্মী পাঠাই। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার নিয়োগদাতারাও চান না আমরা লোক পাঠাই। ফলে এখানে কিছু ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ গত বছর লাখ লাখ টাকা খরচ করেও এ লোকগুলো যেতে পারেননি। তারা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। এটা এ দুই শ্রেণির মানুষের মাথায় নেই। ফলে লোকগুলোকে পাঠাতে কিছুটা বিড়ম্বনা আছে।’

বাড়তি খরচ ১ লাখ ৬২ হাজার

কর্মীরা জানিয়েছেন, গত বছর যেতে না পারা ব্যক্তিদের এবার শুধু বিমান ভাড়া দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন সব মিলিয়ে বাড়তি ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা দিয়ে যেতে হবে। এটা তাদের জন্য খুবই কষ্টের।

বোয়েসেলের দেওয়া নতুন খরচের কাঠামো অনুযায়ী, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ফি ৬ হাজার ৫০০ টাকা থেকে এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার টাকা। একইভাবে সার্ভিস চার্জ আগে ছিল ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং বর্তমানে তা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া সিআইডিবি প্রশিক্ষণ ফি দিতে হচ্ছে ২২ হাজার ৫০০ টাকা। সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে গুনতে হবে আরও ১০ হাজার টাকা। এর বাইরে বিমানভাড়া ধরা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা, যা বাড়তেও পারে। এ খরচ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যেতে ইচ্ছুক কর্মীরা।

আরও পড়ুন

গত বছর সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়েও মালয়েশিয়া যেতে পরেননি পটুয়াখালীর রাব্বি হোসেন। এবার তিনি যাওয়ার প্রাথমিক তালিকায় রয়েছেন। রাব্বি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়েছি। দালালেরা আমাকে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। বাকিগুলো দেয়নি। সেই ঋণ এখনো পরিশোধ হয়নি। এখন আবার যেতে চাচ্ছি, সরকারের উচিৎ ছিল আমাদের বিনা মূল্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।’

রাব্বি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রথমে শুনলাম শুধু বিমানভাড়া দিয়ে যেতে পারব। কিন্তু এখন খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার। শত কষ্ট করে হলেও এ টাকা জোগাড় করে এখন যেতে হবে। গতবার আমরা যেতে পারিনি। অনেকে অন্যান্য দেশে চলে গেছেন। কেউ দেশেই চাকরি করছেন। নতুন করে এত টাকা ধার্য ধরায় অনেকে যেতেও চাচ্ছেন না। কিন্তু আমি যদি এখন না যাই, আগের টাকাও মার যাবে। সেই ক্ষতি চিন্তা করে যাচ্ছি।’

বোয়েসেলের দেওয়া নতুন খরচের কাঠামো অনুযায়ী, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ফি ৬ হাজার ৫০০ টাকা থেকে এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার টাকা। একইভাবে সার্ভিস চার্জ আগে ছিল ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং বর্তমানে তা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার টাকা।

এ নিয়ে কথা হলে বোয়েসেলের নির্বাহী পরিচালক শওকত জাগো নিউজকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার শর্তের কারণে এসব ব্যয় বেড়েছে। সার্ভিস চার্জ বা এজেন্ট ফি মালয়েশিয়ার লোকেরা নিচ্ছেন। এ কর্মী পাঠাতে বোয়েসেলের কোনো আয় নেই। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি খরচ কমানোর। আর আমাদের একাউন্টে কোনো টাকা যাবে না। কর্মীরা ধাপে ধাপে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা খরচ দিয়ে যাবেন।’

লাগবে প্রশিক্ষণ ও সাক্ষাৎকার

বোয়েসেল জানিয়েছে, মালয়েশিয়া সরকার নির্মাণখাতে কর্মী নিতে চাইছে। এ জন্য সিআইডিবি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মূলত তিনটি ক্ষেত্রে কর্মীদের পরীক্ষা দিতে হবে- ইট গাঁথা, প্লাস্টারিং ও কার্পেন্ট্রি বা শাটারিং। প্রক্রিয়ার ধাপ অনুযায়ী, প্রথমে সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। এতে নির্বাচিত হলে কর্মীদের পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে সনদ দেওয়া হবে। উত্তীর্ণ না হলে কর্মীরা যেতে পারবেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোয়েসেলের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, মালয়েশিয়া কিন্ত এর আগে এগুলো বাধ্যতামূলক করেনি। কিন্ত এখন কর্মী নিতে প্রশিক্ষণ ও সাক্ষাৎকার বাধ্যতামূলক করেছে। পরীক্ষায় না টিকলে কর্মীদের নাও নিতে পারে। তারা এ প্রক্রিয়াকে জটিল করেছে।

এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের অনেক এজেন্সি সরাসরি সরকারি উদ্যোগে কর্মী পাঠাতে দিতে চাইছে না। তারা চাইছে পুরো প্রক্রিয়াটি এজেন্সির মাধ্যমেই হোক। এর কারণে যাওয়ার খরচও বেড়েছে।’

আরও পড়ুন

পাঠানো নিয়ে শঙ্কা

শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচিত কর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যেতে চাইলে এ চার মাসে তা কীভাবে হবে? কর্মীদের প্রশিক্ষণ, সনদ, সাক্ষাৎকার, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ফ্লাইট- সবকিছু আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কীভাবে সম্পন্ন করবে? পাশাপাশি কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র পাওয়া নিয়ে আছে শঙ্কা।

এ বিষয়ে বোয়েসেলের নির্বাহী পরিচালক জানান, তালিকাভুক্ত কর্মীর সবাইকে ফোন ও বার্তা দেওয়া হয়েছে। কিছু কর্মী অন্যান্য দেশে চলে গেছেন বলে জানিয়েছে তাদের পরিবার। কেউ কেউ আর বিদেশে যাবেন না- এমনও রয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে জানা যাবে ৭ হাজার ৮৬৯ কর্মীর মধ্যে কতজন যাবেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে সংখ্যাটি বেশি হবে না। অন্যদিকে সিআইডিবির সাক্ষাৎকার থেকে কেউ কেউ বাদ পড়তে পারেন।

চাহিদাপত্র পাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো শিগগিরই ৩ হাজার কর্মীর চাহিদা পাব। অধিকাংশ কর্মী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। চাহিদাপত্র পেলে বাকি প্রক্রিয়া শুরু হবে।’

উল্লেখ, মালয়েশিয়ার বেঁধে দেওয়া সময় ২০২৪ সালের ৩১ মের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও যেতে পারেননি ১৬ হাজার ৯৭০ কর্মী। দুই দেশের সিন্ডিকেট ও অসাধু এজেন্সির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা প্রচেষ্টায় তাদের জন্য মালয়েশিয়ার দুয়ার উন্মুক্ত হয়।

আরএএস/একিউএফ/এমএস

Read Entire Article