মায়ের জানাজাতেও অংশ নিতে দেওয়া হয়নি ল্যান্স নায়েক আলতাফকে

9 hours ago 4

কারাবাসের ১৬ বছরে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন মা, বোন, বোনের স্বামী, ভাগ্নিসহ ২৬ স্বজন। তাদের কারোর শেষ বিদায় জানাতে পারেননি ল্যান্স নায়েক আলতাফ হোসেন। গর্ভধারিণী মমতাময়ী মায়ের মৃত্যুর খবর জানানো হলেও, কারা কর্তৃপক্ষ উত্তরে বলেছিলেন- তাকে পাঠানো সম্ভব না।

অশ্রুসিক্ত চোখে কালবেলাকে এসব কথা বলেছেন বিডিআর সদস্য ল্যান্স নায়েক আলতাফ হোসেন।

আলতাফ হোসেন বরগুনা সদর উপজেলার ১নং বদরখালী ইউনিয়নের বাওয়ালকার গ্রামের বাসিন্দা। ২০০৯ সালের রাজধানীর পিলখানায় সংগঠিত বিডিআর বিদ্রোহ মামলার আসামি হয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর জেল হাজতে ছিলেন এই বিডিআর জোয়ান।

দেশপ্রেমের টানে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ বিডিআর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন টগবগে যুবক আলতাফ হোসেন। ২০০৯ সালে পিলখানার ১৩নং ব্যাটালিয়নে কর্মরত থাকার সময় পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি।

পরে আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করা হয়। বিভাগীয় মামলায় তার সাত বছরের কারাদণ্ড এবং দায়েরকৃত হত্যা মামলায়ও অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও বিস্ফোরক আইনে দায়েরকৃত মামলাটিতে গত ১৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় আলতাফ হোসেনকে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে গত ২৩ জানুয়ারি কারামুক্ত হয়ে ১৬ বছর পর বরগুনায় নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন আলতাফ হোসেন। গ্রেপ্তারের সময় ২ বছর বয়সী এক ছেলে এবং ৪ বছর বয়সী এক মেয়েকে রেখে কারাবন্দি হতে হয় আলতাফকে।

কারাগারে যাওয়ার প্রথম ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরেই ভাগ্নীর মৃত্যু দিয়ে শুরু হয় আলতাফের স্বজন বিয়োগ। একে একে বোন, বোনের স্বামী, চাচা, সর্বশেষ ২০২২ সালে মৃত্যু হয় মা আমেনা বেগমের। গর্ভধারিণী মা, বোনসহ ২৬ স্বজনের চিরবিদায় উপলক্ষেও একটিবারের জন্যও তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়নি। শেষবারের মতো দেখতে পারেননি প্রাণপ্রিয় মায়ের মুখ।

দীর্ঘ ১৬ বছর পর কারামুক্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে আসায় এ বিডিআর সদস্যের আনন্দের ঢল নেমেছে। দীর্ঘ কারাভোগের পর জামিনে বাড়িতে ফিরে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন আলতাফ। তাকে ঘিরে স্বজনদের উচ্ছ্বাস, স্ত্রী-সন্তানদের আবেগঘন মুহূর্ত আর সবার চোখে আনন্দের অশ্রু স্পষ্ট। স্বজনরা দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন আলতাফের সঙ্গে দেখা করতে। ছেলেকে নিয়ে  বিভিন্ন স্মৃতি বিজড়িত স্থানসহ বিভিন্ন স্বজন ও মায়ের কবর দেখতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। সন্তানদের ছোটবেলার স্মৃতির কথা মনে করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।

দীর্ঘ বছর পরে বাবাকে কাছে পেয়ে ছেলে আকিব হোসেন রাফি বলেন, বাবা হলো একটি পরিবারের বটগাছের মতো। সেই বাবাই ছোটবেলা থেকে আমাদের কাছে ছিল না। ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি বাবা দূরে কোথাও আছেন। বুঝতে শেখার পরে জেনেছি বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বাবা কারাগারে আছে। এই বিষয়টির নেগেটিভ প্রভাব আমাদের মাথায় ছোটবেলা থেকেই পড়েছে। ছোটবেলায় যখন দেখতাম স্কুলের বিভিন্ন বাচ্চাদের তাদের বাবা গিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু আমরা বাবার সেই আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। দীর্ঘ বছর বাবাকে ছাড়া আমাদের পথ চলটা খুবই কষ্টের ছিল। মা একা আমাদের মানুষ করেছে। 

স্বামীকে ফিরে পেয়ে স্ত্রী শিরীন সুলতানা বলেন, দুই সন্তানের লেখাপড়া, খাবার, মামলা চালানোর খরচ সবকিছু সামলাতে আমাকে সীমাহীন কষ্ট করতে হয়েছে। দীর্ঘ ১৬ বছর স্বামী থাকতেও স্বামী ছাড়া থাকতে হয়েছে, এ কষ্ট শুধু একজন ভুক্তভোগী নারীই বুঝতে পারবে। আমার মেয়েটাকে ডাক্তারি পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলে থাকায় তা আর সম্ভব হয়নি। আল্লাহর হুকুম এবং আমার বাবা, মা, ভাই ও দেবরের সহযোগিতায় যতটুকু সম্ভব হয়েছে ছেলে-মেয়েদের জন্য চেষ্টা করেছি। এমনও অনেক দিন গেছে টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই। এটি একজন নারীর জীবনে কতটা কষ্টের, তা বলার ভাষা নেই।

তিনি আরও বলেন, যখন ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম তখন ছেলে তার বাবাকে চিনতে পারতো না। বাবা তার মেয়েকে চিনতে পারতো না। আমরাও এই দেশের জনগণ কিন্তু সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকার কখনো কোনো বিডিআর সদস্যের পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়নি। এছাড়াও যখন আমার শাশুড়ি মারা যায়, তখন সরাসরি আমি জেলারের কাছে ফোন করেছিলাম। জানাজায় উপস্থিত থাকতে এবং মৃত মাকে দেখার জন্য অনুমতি চাইলেও তিনি তখন বলেন সম্ভব না। অবশেষে ১৬ বছর পর জামিনে আমার স্বামীর মুক্তি মিলেছে।

এসময় তিনি পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় স্বামীসহ সব চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের পুনরায় চাকরি ফেরত এবং ক্ষতিপূরণসহ বেতন ভাতা পরিশোধ করার দাবি জানান। 

ল্যান্স নায়েক আলতাফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছরে আমার মা, বোন, বোনের স্বামী, ভাগ্নীসহ ২৬ জন আত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে। একটি বারের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়নি আমাকে। আমি আমার মাকেও শেষবারের মতো দেখতে পাইনি। মায়ের মৃত্যুর খবর জেলারকে জানানো হলেও, আমাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয় বলে আমার স্ত্রীকে জানানো হয়েছে।

পিলখানার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিলখানা একটি বড় এলাকা, সবকিছু আমরা জানি না। কী ঘটেছিল, তা বলতে পারব না। নতুন করে তদন্ত করা হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস এখন সবকিছুরই সঠিক তথ্য বের হয়ে আসবে।

ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বিডিআর সদস্যদের জন্য বিডিআর কল্যাণ পরিষদ নামে একটি গ্রুপ আছে। ওই পরিষদের মাধ্যমে আমাদের চাকরির পুনর্বহাল, আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়াসহ যে সিদ্ধান্ত আসবে আমি সেই সিদ্ধান্তে একমত। সর্বোচ্চ আদালত থেকে কয়েকবার আমি হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছি। কিন্তু বারবার আপিল করে আমাদের আটকে রাখা হয়েছে। যেহেতু আমি হত্যা মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। তাই চাকরি পুনর্বহাল এবং ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়।

Read Entire Article