বাবাকে হারিয়ে ভারতের বিহার থেকে মায়ের হাত ধরে বাংলাদেশে এসেছিলেন সামি আহম্মেদ খান (৭০)। থাকতে শুরু করেন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ইলিশকোল গ্রামে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর। অবাঙালি হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন প্রাণপণ।
কখনো ছুটেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আটক যুবকদের উদ্ধারে। কখনো ছুটেছেন সরকারি স্থাপনা রক্ষা করতে। কখনো আবার বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। স্থানীয় হিন্দু বাড়িগুলো রক্ষা করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয়ও নিয়েছিলেন তিনি।
এত কিছুর পরও মেলেনি সরকারি স্বীকৃতি। জীবনের শেষকালে নিজের জন্য না হলেও সন্তানরা যেন সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, এজন্য স্বীকৃতি চান। এরই মধ্যে তার চোখে দেখা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করার গল্প মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে R-৩৮২৩৮ নম্বরে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
এভাবেই অবাঙালি বিহারি সামি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। অশ্রুভরা চোখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের কথা বলছিলেন, এখন বেশ ভালোই কাটছে তার। তিনি বলেন, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ভালো আছি। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। বড় ছেলে গিয়াস উদ্দিন খান (৪৩) সিমেন্ট কোম্পানির হয়ে মাগুরায় কাজ করে। ছোট ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী, সে বাড়ি দেখাশোনা করে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করছেন।
বড় ছেলে গিয়াস উদ্দিন খান অশ্রুভরা চোখে বলেন, আমাদের লোকসমাজে নিজেদের পরিচয় দিয়ে খারাপ লাগে। আসলেই তো মহান মুক্তিযুদ্ধে বিহারিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালি করেছে। তাদের ওইসব কর্মকাণ্ডে বাঙালিরা ঘৃণাভরে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। অনেকেই যারা মুক্তিযুদ্ধে বাবার অবদানের কথা জানেন না, তারাও আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। তখন খুব খারাপ লাগে। আমরা যেভাবে চলছি, যাতে আমাদের সন্তানদের একই অভিশাপ নিয়ে চলতে না হয়। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে বাবার অবদানের স্বীকৃতি চাই। এ ছাড়া আমরা কোনো সুযোগ-সুবিধা চাই না।
বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে কথা হয় স্থানীয় হিন্দু পরিবারের সদস্য অশোক লাহিড়ীর সঙ্গে। তিনি জানান, ‘সামি আহম্মেদ অবাঙালি বিহারি হলেও স্বাধীনতার সপক্ষে কাজ করেছেন। আমাদের এ এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত। তিনি এলাকায় বসবাস করেন যুদ্ধের আগে থেকে। এলাকায় যাতে কোনো বিহারি ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আসতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করছেন। তার ভালো কাজে জন্য তার সঙ্গে এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের পরিবার আত্মীয়তা করেছে।’
আসলেই সামি আহম্মেদ খান মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন কি না, সেটি নিশ্চিত হতে কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আকমল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সামি আহম্মেদ খান বিহারি; তবে যুদ্ধকালীন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। শুধু তিনি না, তার মাও আমাদের জন্য কাজ করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গাড়ি এলে তার মা তাদের ভুল বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেতেন। সামি অনেক সময় আমাদের সঙ্গে থেকেছে। কখনো আমাদের তথ্য পাচার করেনি। তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তথ্য আমাদের দিতেন। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও সামি মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।’