মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধীরা কাদের উত্তরসূরি?

3 months ago 19

রাজাকার, আল বদর আর ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা মন্ত্রী হয়েছেন। ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতায় সেই তাদের চরম বিরোধিতা ও বৈরিতার মুখে স্বাধীনতা পাওয়া এই দেশে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন তারাই। যে লোকেরা ভিনদেশী পাকিস্তানীদের পথ চিনিয়ে কোন বাড়িতে মুক্তি আছে, কোন বাড়ির মেয়েরা বালেগ হয়েছেন কিংবা নাবালিকা হলেও সুন্দর তাদের বাড়ি চিনিয়েছেন ভিন দেশীদের। পাকিস্তানী সেনাসদস্যদের যৌনসুখের যোগান দিতে এমন কিছু নাই করেন নি। সেই রাজাকার আলবদরেরা মন্ত্রী হয়ে তাদের গাড়িতে পতপত করে উড়েছে রক্তের বন্যায় পাওয়া স্বাধীনতা। তখন আজকের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধীরা কোথায় ছিলেন?

ধরেই নিলাম তারা বয়সে হয়ত নালায়েক ছিলেন কিন্তু রাজাকারের গাড়িতে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়তে দেখে তাদের বাবা চাচা বা দাদাদের শরীরের পশমে কী টান পড়েছিল? হৃদযন্ত্রে খানিক ধাক্কা লেগেছিল? না এসবের কিছুই হয়নি! যদি হতো তবে নালায়েক নাবালক সেদিনের তরুণ যুবাদের স্মৃতিতে কিছু হলেও থাকতো। যে দেশে চিহ্নিত রাজাকার আল বদর আর তাদের উত্তরসূরিরা নানান পদ-পদবি, মন্ত্রিত্বের মর্যাদা পান, গাড়িতে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে ঘোরেন নানান সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন তখন আজকের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা কোথায় থাকেন? যখনই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান স্বজনদের জন্য নামে মাত্র কোটা বরাদ্দ হয় তখন আপনারা যারা ফাল দিয়ে উঠেন?

তাদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পরিচয় জানতে বড্ড ইচ্ছা হয়-আপনারা কারা কাদের উত্তরসূরি? সরকারের সংশ্লিষ্ঠ গোয়েন্দা সংস্থা ও তথ্য সংগ্রহকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরা যদি তাদের পরিচয় সনাক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি। আন্দোলনকারীরা কী অমুক মুক্তিযোদ্ধা কিংবা নাতিনের ঘরের পুতিন কিংবা অমুক রাজাকারের নাতিনের ঘরের সতিনের ছেলে? আন্দোলনকারীদের পরিচয় শনাক্ত করে তাদের মোটিভ উন্মোচন আজ খুব জরুরি।

আপনারা কী এমন ঘটনা জানেন, যে মুক্তিযোদ্ধার এক সন্তান লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন, উপরন্ত রের্কড পরিমাণ নম্বরও পান। কোটার নীতি মত সেই সন্তানটিকে শুধুমাত্র ভাইভাতে গিয়ে সেই কোটার প্রয়োগ বা সুযোগ দেয়া হয়। তবে বাস্তবতা হলো নারী কোটা, জেলা কোটা, লিখিত পরীক্ষার রের্কড নম্বর পেয়েও শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কোটার আবেদন করেছেন বলে সেই শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীকে ভাইভা বোর্ডে আপেক্ষামান রুমে বসিয়ে রাখা হয় ঘন্টার পর ঘন্টা! সেই পরীক্ষার্থীর আকুতির মুখে ভাইভা বোর্ডে বিচারকদের সামনে নেওয়া হলেও সেই শিক্ষার্থীকে কোন প্রশ্নই জিঙ্গেস করা হয় নি বরং বলা হয়েছে, তোমার ভাইভার কী দরকার মুক্তিযোদ্ধার সনদ ধুয়ে খাওগে.....এসব বাস্তবতা এবং এমন অদ্ভুত সত্য বাস্তব ঘটনা এদেশেই ঘটেছে!

কষ্ট হয় বড় কষ্ট, এদেশের চোর-দুর্নীতিবাজরা চুরি করে পার পায়। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিলেও কোন সম্মানহানী হয় না। অথচ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করা শিক্ষার্থীকে ভাইভা বোর্ডে এই সমাজের দর্পন শিক্ষককূল তাদের সন্তানের বয়সী স্বপ্নবাজ পরীক্ষার্থীকে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় আবেদন করায় লজ্জা দেন, অপদস্থ করেন! একবারও তারা ভাবেন না এই শিক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষার কতবড় ঝক্কি, লম্বা পথ পেরিয়ে তবেই ভাইভা বোর্ডে এসেছেন। সেই শিক্ষার্থীকে ভাইভা বোর্ডের পবিত্র জায়গায় কতক অমানুষ সদস্য-শিক্ষকেরা সম্মিলিতভাবে অপদস্থ করছেন।

এর ফলে একজন শিক্ষার্থী এদেশের একজন সন্তানের মানসিকতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে? কোন ধরনের ট্রমায় আক্রান্ত হতে পারেন সেই শিক্ষার্থী তা একবারও ভাবেন নি! যে পবিত্র সংবিধানের প্রতি সম্মান জানিয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মত উচ্চতর এক সাংবিধানিক কাঠামোতে সকলের প্রতি ন্যায্যতা ও নীতির প্রতি অবিচল থাকার শপথ নিয়ে ওই পদে গিয়েছিলেন তারা। সেই ভাইভা বোর্ডের সম্মানিত শিক্ষক ও সদস্যরা সেদিন কী তাদের সেই অঙ্গীকার মত পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছিলেন?

আশ্চর্য বাস্তবে দেখেছি, ‘বাপে মানে না মায়ে গছে না’ এমন লোকও মামা শ্বশুরের জোরে লবিং করে এনজিও’র অনুমোদন নেন। জোর তদবিরে লবিংয়ের জোরে পত্রিকার লাইসেন্স পান! দেশ-বিদেশ ঘোরেন, ভিন্ন দেশে মরুর বুকে কবিতা গাইতে যাবার তদবির করেন তখন তাদের লজ্জা লাগে না! কিন্তু যখনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রের সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রীয় খরচে হজে নেওয়া হয় তখন সেই তারাই নিজের কাজে না পরের কাজে লজ্জা পান!

অদ্ভুত না? এযেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি! রাষ্ট্রের সুবিধাভোগীরা এক মুক্তিযোদ্ধাকে হজ্জে নেওয়ায় পারলে মুক্তিযোদ্ধার মূল্যবোধের পোস্টমর্টেম করেন! অথচ ওই জ্ঞানী-গুণীজন আপনারা যে সারাদিন লবিং আর তেলবাজি করে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কতকিছু ছলেবলে কৌশলে আদায় করেন তখন সেই সবের হিসেব মুক্তিযোদ্ধারা রাখে না রাখে আজকের আন্দোলনকারীরা?

শোনেন ভায়া মুক্তিযুদ্ধের, কোটাবিরোধীরা, ১৯৭১'র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, সত্যিই যারা সন্মুখসারির যুদ্ধের ময়দানে গিয়েছিলেন তাদের বেশির ভাগ সাধারণ আম-জনতা। কঠিন কঠোর ,মূল্যবোধওয়ালা সত্যিকারের দেশপ্রেমীক। যাদের হৃদয় একপোয়া নয় পাঁচসেরের হৃদয়ের হৃদয়বান তাঁরা। কারণ যুদ্ধের ময়দানে খেয়ে না খেয়ে সাপ, পোকা, বেজি, ইদিুর-বাঁদুর আর বিশ্বের অন্যতম সেরা রণসজ্জার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সমরে শক্তিতে বলিয়ান সেই পাকিস্তানী সেনাদের বেয়োনেট ও গুলির মুখে নিজেদের বুক চিতিয়ে জীবন বাজি নিয়েই বুকের কলিজাটা হাতে নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন তাঁরা!

বান্তবতায় সেই প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ও তাদের সন্তান পরিবারের কতজনকে দেখেছেন? যুদ্ধের বছর যে ছেলেটি ছিল সবচেয়ে মেধাবী ক্লাসে প্রথম সেই ছেলে যুদ্ধে গিয়ে হাত কিংবা পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন! একসময়ে মেধাবী তরুণ অসহায় জীবন যাপন করছেন। আর যারা যুদ্ধ থেকে জীবন নিয়ে ফেরেন নি সেই পরিবারের স্বজন-প্রিয়জন, স্ত্রী পুত্র কন্যাদের কী অবস্থা গেছে সেই খবর আপনি-আমি কী রেখেছিলাম! তাদের সন্তানেরা মেধাবী হলেও পিতার বা পরিবারের অসহায়ত্বের কারনে উচ্চশিক্ষা, উন্নত জীবন মানের সন্ধান হারিয়ে ধুকে ধুকে জীবন কাটিয়েছেন! যুদ্ধে যাবার অপরাধে তাদের বাড়ি লুট হয়েছে।

এমনও হয়েছে রাজাকার আলবদরোর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, ভিটে মাটি ও ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে রাগে-ক্ষোভে। স্বাধীণ দেশে তাদের আবার নতুন করে বাঁচতে যে সংগ্রাম করতে হয়েছে তখনো সেই প্রকৃত যোদ্ধারা রাষ্ট্রের-সমাজের তরফে সাহায্য সহযোগিতা পাননি। তখনো সুবিধাভোগীরা হরিলুট করে নিজেদের পাতেই ঝোল টেনেছে। সুতরাং এক যুদ্ধাহত বা স্বজন হারানো হতভাগ্য বীরযোদ্ধা পরিবার ও তাদের সন্তান স্বজনদের টিকে থাকার লড়াই কেমন ছিলেন রাজধানীর সুযোগ সবিধার শহরে বসে ভাবাটা খুবই কঠিন।

বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হবার পর এই বীরদের জন্য কিছু করার চেষ্টা শুরু করেছেন বটে তবে ১৯৭৫’এ বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর স্বাধীন দেশে আবারো পরাধীনতার শেকলে আটকে পড়েছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বীর সেনানী ও তাদের স্বজন সন্তানেরা। স্বাধীনতার সময় মুক্তিকামী বীরদের সহায়তা করার অভিযোগে স্বদেশী ভাবনায় আপ্লুত কতক ব্যবসায়ীকে রাষ্ট্রীয় ভাবে নিগৃহীত করা হয়েছে রাজা হওেয় পথে বসেছেন এমন কয়টি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের খর জানেন আজকের কোটা বিরোধী আন্দোলনকারী? দুভাগ্য আমাদের নিজ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করার মত জ্ঞান নেই আজকের এই প্রজন্মের। যারা নিজ দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে দীর্ঘ রক্তাক্ত পথ পরিক্রমরার ইতিহাস এবং বীরদের সম্পর্কে কিছুই জানে না? এই প্রজন্ম এদেশের জন্য কী অবদান রাখবে? যারা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আত্মত্যাগ করে যেভাবে পরাজিত শক্তি ও তাদেও দোশরদেও দ্বারা স্বাধীন দেশে নিগৃহীত হয়েছে এই খবরই জানেন না। এতসব জানান তো দুরের কথা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারকে দেখার সৌভাগ্যও হয়নি আপনাদের?

প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাদের স্বজন, সন্তানেরা এই সমাজেই আছেন। তবে পানির নিচের আইসের মত ডুবে আছেন! তাদের মাত্র এক ভাগ দেখা যায়, বাকী তিন ভাগ পানির নিচে সেই আইসবার্গের ন্যায় লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। একারণে এ সমাজের সন্মুখসারি আলোকিত অবস্থানে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান বরারবই খুবই কম। তাই সুখ-সমৃদ্ধির অবস্থানে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেন নি আর দেখবেনও না। কারণ সেই প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান-স্বজনদের যে ট্রেন ফেইলের মত একবার জীবনের ট্রেন সময়মতো সুখের স্টেশনে পৌঁছেনি পিতা বা স্বজনের দায়ে অসহায়ত্বের কারনে।

সেই ১৯৭১ এ একবার জীবনের খেরো খাতার হিসেবে যেভাবে তাঁরা ছিটকে গেছেন তাতে তাঁরা সমাজের আলো-উন্নয়নের সারিতে পৌঁছাতে আর কোন দিনই পারবেন না। যদিও নিঃস্বার্থ ভাবেই তাঁরা দেশের জন্য সময়ের প্রয়োজনে লড়েছিলেন বিনিময়ে তাদের চাওয়া-পাওয়ার কোন প্রত্যাশাই ছিল না। সেই যে পিছিয়ে পড়া লাইনচ্যুত প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান-স্বজনদের জীবনের লাইনে আনতে এখনো মুক্তিযোদ্ধার কোটা বহাল রাখা খুব প্রয়োজন।

আরো কী জানেন, আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান বাবা, চাচা ও তাদের স্বজনদের বাস্তবে কাছ থেকে দেখেছি, তারা বিত্তশালী ও ভোগবাদী নয়। আজ মুক্তিযোদ্ধা নামে অর্থ ও বিত্তশালী যাদের দেখছেন, তাদের সবাই সমাজের সুবিধাভোগী। তাদের বেশিরভাগ যুদ্ধের ময়দান পালালেও স্বাধীনতার পর সুবিধা আদানে এগিয়ে ছিলেন। আমার বাবার সাথে তাঁর বিত্তবান যে বন্ধুরা আবেগের বশে সহযাত্রি হয়ে যুদ্ধ করার মনোবৃত্তি নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গিয়েছিলেন সংখ্যায় সমবয়সী ও একই এলাকার ১৫ থেকে ২৫ জন। শেষ পর্যন্ত সেই বন্ধু গ্রুপের মাত্র ৭-৯ জন প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে যুদ্ধ করেছেন।

বাকিরা কদিন এদিক সেদিক ঘুরে, হোটেলে আরাম-আয়েশে কাটিয়ে যুদ্ধদিন গুজরান করেছেন। তাদের তাদের কেউ কেউ প্রশিক্ষণ শেষ না করেই পালিয়ে গেছেন। কারণ যুদ্ধের ময়দানের অনিশ্চয়তা, কঠোর-কঠিন পরিশ্রম, দিনের পর দিন ভালো মন্দ দুরের কথা না খাওয়া পরিস্থিতি তারা মানাতে পারেন নি। যুদ্ধের ময়দানেও তারা ঘরের সেই আরাম আয়েশের জীবনের মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। যুদ্ধ করার জন্য যে সাহস ও কঠিন আত্মত্যাগী মনোভাবের প্রয়োজন হয় বেশির ভাগের সেই সাহস ও মনোবৃত্তি ছিল না। ফলে ১৯৭১’র ভয়াবহ যুদ্ধদিনে প্রশিক্ষণের নামে পালিয়ে ভিন্ন দেশে কোন মতে ঘাপতি মেরে পার করেছেন।

১৯৭১’র ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র তারা দেশে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে সেই আগের সুযোগ-আরাম-আয়েশের জীবনে ফিরেছেন। লেখাপড়া শুরু করেছেন, চাকরি উচ্চশিক্ষা সবই শুরু করে নিজেকে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছেন নতুন রুটিনে। আর সত্যিকারের অকুতোভয় বীররা যুদ্ধদিনের ভয়াবহতাকে জয় করে কী করেছেন জানেন, উচ্চশিক্ষায় রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপে পালিয়ে বা পাড়ি দেন নি। বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশকে গড়ে তুলতে নিজেকে আরেক দফায় নিয়োজিত করেছেন।

উচ্চশিক্ষার হাতছানি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সব অচল প্রায় ভাঙ্গাচুরা ক্ষতবিক্ষত রুগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলো যেন আবারো সচল হয় তাই ছোট বড় পদ পদবি ভাবেন নি যে যে পদে পেরেছেন যোগদান করে দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন দিনের সূচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তবে যুদ্ধদিনে ময়দান পালানো ভিরুরা ঠিকই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বসবাসযোগ্য স্বাধীন দেশের সুসময়ে ফিরেছেন। দেশে ফিরে নতুন নতুন পদবিতে পাভারি আর পশ্চাৎদেশ উচিয়ে উপভোগ করেছেন চাকরির পদ-পদবির ভারিক্কি ওজন! এখনো কী বোঝা গেছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেই হাল ছাড়েন নি।

বরং সংসারের ন্যায় জোড়াতালি দিয়ে ঘরে এক ছটাক চাল তেল, কুপি জ¦ালানোর কেরোসিন ছিল না এক ছটাক সেই অন্ধকার অবরুদ্ধ অবস্থায় যে কৃষক বা গ্রামের ছেলেটি যুদ্ধে গিয়েছিল সে তিনি জ্বালানো উপড়ানো শূন্য ঘরে ফিরে নতুন করে শ্রম দিয়ে মাটির ঘর গেঁথেছেন। যে ঘরে ফল, ফসলের বীজও ছিল না সেই শুন্য, ভাঙ্গাচোরা, তছনছ, ফল-ফসলহীন এদেশের ৬৬ হাজার গ্রাম বাংলার ঘরে মাটিতে ফল ফসল ফলানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন অঙ্গ হারানো সেই সাধারণ বীর মুক্তিযোদ্ধারা। যে তরুণ ভালো ফলফল করে পরিবারের আশা ভরসার একমাত্র অবলম্বন ছিলেন সেই তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে না গিয়ে নিজ দেশের কল-কারখানা, অফিস-আদালতে জয়েন করে নামমাত্র বেতনের চাকরি নিয়ে নিজের শ্রম আর উদ্যোগ দিয়ে দেশকে সচল করতে ভূমিকা রেখেছিলেন।

বাবা, চাচা বা আর কোন স্বজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে গিয়ে থাকলে তাদের কাছে যুদ্ধ দিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানুন। তাদের মুখে কিছু গল্প অনন্ত শোনার সৌভাগ্য হলে আপনাদের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন অ্যালার্জি থাকবে না আশা করি। তবে এটা শতভাগ ঠিক যে, যুদ্ধ দিনের ভয়াবহ ঘটনা আর যে অদম্য সাহসে যে মানুষুগুলো ১৯৭১’এ অস্ত্র ধরেছিলেন তাঁরা দেশ স্বাধীন হবে, স্বাধীন বাংলাদেশ পাবেন এর বাইরে আর কিছুই আশা প্রত্যাশা করেন নি, কোটা-ফোটা তো বহুত দূরের কথা।

এর জন্য নিজের উচ্চশিক্ষার মোহ মুগ্ধতাকে আমলে নেননি সেই বীরেরা। কথায় বলে সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশফোঁড়....প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের তারুণ্যময় কর্মমুখর সময় আর দেশের অসময়ে নিজেদের আবেগ আনন্দ উন্নয়ন সবই জলাঞ্জলি দিয়েছেন। সেই ত্যাগের মূল্যায়ন রাষ্ট্র সমাজ করবে না? দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন তাঁর যে শ্রম, ঘাম, আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত রেখেছেন তার মূল্য এদেশ ও রাষ্ট্র দেবে না? যারা নিজের ভালো, আবেগ-উন্নয়ন না দেখে দেশের জন্য নিজ স্বার্থ ত্যাগ করলো সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোন উদ্যোগ নিলে, কোন সুযোগ সুবিধা দিলেই আপনাদের কেন জ্বলুনি হয়? আপনারা কারা আপনারা কী পাকিস্তানের পরাজিত শক্তির উত্তরসূরি, জীবিত কিংবদন্তি?

ইতিহাস পড়ুন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এমনকি আর যেসব দেশ রক্ত দিয়ে স্বাধীন করেছে সেই সব দেশে বীরদের ‘হিরো’ গণ্য করে কীভাব মর্যদার পাশাপাশি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় দেখুন জানুন খোঁজ নিন। পারলে পরিবারের মুক্তিযোদ্ধা বাবা, চাচা ও কাছের স্বজনদের কেউ থাকলে তাদের মুখে শুনুন যুদ্ধদিনের ভয়াবহ সব গল্পগাথার বাস্তব কঠিন ও দুঃসহ সব ঐতিহাসিক সত্য। তবেই এই বীর মুক্তিযোদ্ধা-হিরোদের কদর বুঝতে পারবেন আপনারা।

তবে আজকে যারা আমার আপনার চারপাশে নানান সুযোগ সুবিধায় বেষ্টিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যারা ভিরু, কাপুরুষ যারা আমার আপনার বাবা চাচাদের সাথে যুদ্ধে যেতে ঘর ছেড়েছিলেন বটে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান যে ভোগ-আরাম-আয়েসের জায়গা না বুঝে কঠিন দুঃসহ সময়ে সেই যুদ্ধদিনে সামিল হতে গিয়েও ভোগের জীবনে ফিরে এসেছিলেন তাদের দেখে প্রকৃত বীরদের মূল্যায়ন করবেন না প্লিজ।

যদিও সেই ভিরুরাই যুদ্ধদিনে ময়দান পালানো সেই চেনা মুখগুলোই আজ মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের প্রথম সারিতে। কারণ, যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে তারাই সময়মত লেখাপড়া শেষ করে খেয়ে পড়ে আরামে আয়েশে উন্নত জীবন গড়েছেন। তাতে খুব দোষের কিছু না তবে ময়দান পালানো সেই ভিরুরাই যখন মুক্তিযোদ্ধার বেশে প্রকৃত যোদ্ধাদের বীরত্বকে খাটো করে পুরো রাষ্ট্রে, সমাজে, ব্যক্তি-বর্গে সর্বোপরি নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযোদ্ধা নামের মাহাত্ম্যে কালিমা লেপে বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে অভক্তির সৃষ্টি করে তাদের বিচারে কাঠগাড়ায় তুলবে কে? আপনারা নতুন প্রজন্ম আপনারা তা না করে পুরো একঝুড়ি আমের মধ্যে পচা এক দুটি আমের কারণে পুরো ঝুড়িকে পরিত্যক্ত করছেন? তাই আপনাদের মত নতুন প্রজন্ম যারা নিজেদের অস্তিত্বের খোঁজ জানেন না স্বাধীনতার মানে বোঝে না অঅপনাদেও নিজের মেধা ও মননের জোর কম হবে এটাই স্বাভাবিক!

নিজ দেশে স্বাধীনতার সুখ কী যারা বোঝে না তারাই বীরদের হেলা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সামান্য কোটা নিয়ে যুদ্ধে নামে। সেই ভীতু যুদ্ধের দামামায় ভয় পাওয়া সুবিধাভোগীদের উত্তরসূরি বুঝি আপনারাই। উপরন্ত সেই ভিরু যুদ্ধের ময়দান পালানো মানুষগুলোই আজ মুক্তিযুদ্ধের ধার করা স্মৃতিকথায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, পদ, পদবির জোরে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা নিচ্ছে-তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন আজকের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধীর আপনারা। আপনা পিতা দাদা চাচারা যে বিলাসী ও ভোগের নানান উপঢৌকন ও সুযোগ, মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা মঞ্চে...আপনার প্রিয়জনেরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নাতো?

আপনাদের পূর্ব পুরুষেরা যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদধারীরা বন্ধুর কাছ থেকে যুদ্ধদিনের কিছু স্মৃতি মুখস্ত করে নিজেদের ভাগ্য বদলেছেন, আপনারা তাদের উত্তরসূরি হয়ে মুক্তিযোদ্ধার কোটা বিরোধী আন্দোলন করবেন এটাই স্বাভাবিক। ভীরু যুদ্ধের ময়দান পালানো কাপুরুষদের মতই আপনারা নিজের মেধা ও মননের শক্তিতে বলিয়ান নয়। আরে ভাই লিখিত পরীক্ষায় পাস করে তবেই ভাইভাতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় খানিক সুবিধা পাবেন। সেই পর্যন্ত মেধার জোরে আপনি আমি আর দশ-বিশ হাজার, লাখ কিংবা কোটি শিক্ষার্থী সবাই সমান। সাহস থাকলে মেধার লড়াইতে নামুন, কোটা বিরোধী আন্দোলন করে নিজের অস্তিত্বের অপলাপ করবেন না।

আর বাবা, চাচা বা আর কোন স্বজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে গিয়ে থাকলে তাদের কাছে যুদ্ধ দিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানুন। তাদের মুখে কিছু গল্প অনন্ত শোনার সৌভাগ্য হলে আপনাদের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন অ্যালার্জি থাকবে না আশা করি। তবে এটা শতভাগ ঠিক যে, যুদ্ধ দিনের ভয়াবহ ঘটনা আর যে অদম্য সাহসে যে মানুষুগুলো ১৯৭১’এ অস্ত্র ধরেছিলেন তাঁরা দেশ স্বাধীন হবে, স্বাধীন বাংলাদেশ পাবেন এর বাইরে আর কিছুই আশা প্রত্যাশা করেন নি, কোটা-ফোটা তো বহুত দূরের কথা। ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে কোন প্রলোভনই তাদের সামনে ছিল না। শুধুই ছিল স্বাধীন দেশে নিজের মত বাঁচার প্রবল আশা ও ভরসা।

কী দুর্ভাগ্য আমাদের এদেশের তরুণ সমাজের। যে দেশে উচ্চবিত্তের উচ্চপদধারীরা উত্তরা গুলশান, বনানীতে, রিমঝিম, পূর্বাচল বা পশ্চিমাচল নামে, বেনামে প্লট, ফ্ল্যাট আর কোটি টাকার শুল্কমুক্ত গাড়ি পেতে পারেন তাতে দোষ নেই। তখন প্রতিবাদ করার কেউ থাকে না, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করলেই গাঁ জ্বলে যাদের আপনারা কারা। তাদের চিহ্নিত করার আবেদন করছি। আজ রাজনৈতিক বিকিকিনিতে ব্যবহার হয় দেশ, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুটি। দুর্বত্তায়নের উদ্দেশ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত যোদ্ধোদের আবেগ-অনূভুতি কেন বুঝবে?

তবে সময় যেভাবে এগোচ্ছে আপনাদের না হোক আপনার সন্তান নাতিপুদের হয়তো নিজের দেশে পরাধীনতা কী তার মুখোমুখি হতেই হবে সেদিন বুঝবেন দেশের স্বাধীনতা কী এক অমূল্য রতন? কেন এই মনি-মানিক্যসম স্বাধীনতার জন্য আম-জনতা সাধারণ মানুষ প্রাণ দিতে পিছপা হন নি? তবে সেদিন আর দূরে নয় সহসায় হয়ত নিজ দেশে পরবাসী হয়ে চাকরী, টিকে থাকার প্রয়োজনে স্বাধীনতার মাহাত্য রক্ষায় আবারো লড়ার প্রয়োজন হবে। কিন্তু এই আপনারাই আপনার পূর্বসূরি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আর রাষ্ট্রের সুশীল-সুবিধাভোগীদের মতই দেশের প্রয়োজনে আপনার স্বজন-সন্তানেরা এক পা এগুলে দশ পা পিছিয়ে যাবেন নিশ্চিত।

আত্মকেন্দ্রিক কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী আপনাদের বেশির ভাগই উন্নত জীবন মানের আশায় প্রত্যাশায় ইউরোপ, আমেরিকা কানাডা, মালেয়েশিয়াতে যেভাবে পাঠিয়ে রাখছেন দেখবেন একদিন আপনার স্বজন সন্তানেরা নয়, কাবুলিওয়ালাই এদেশ চালাচ্ছেন। সেদিন হয়ত ১৯৭১’র সন্মুখ সমরের সাহসী যোদ্ধাদের আবারো প্রয়োজন হবে। তবে কী জানেন সেই প্রকৃত বীর আর তাদের মত সেই আবেগ ও দুঃসহকে জয় করার সাহসী সন্তান এদেশের মাটিতে আর কেউই থাকবে না।

আজকের লুটেরা, সুবিধাভোগী নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে ‘খাল কেটে কুমি আনার’ দলে ভিড়েছেন বিনিময়ে গ্রামে, গঞ্জে, শহর-বন্দর রাজধানী ছাড়িয়ে কানাডার বেগম পাড়ায় বিত্তের পাহাড় গড়েছেন এর পরিণতি যে কী ভয়াবহ হবে যা আগাম উপলব্ধি করার মত অন্তরচক্ষু মন ও মেধা সর্বোপরি সামান্য দেশ প্রেম আপনাদের আছে কী? সুতরাং আপনারা স্ববিরোধী, দেশবিরোধী, স্বাধীনতার স্মারক ও বীরদের পচিয়ে-গলিয়ে কাবুলিওয়ালাদের পথ সুগম করুন। কোটাবিরোধী আন্দোলন করুন, এভাবে আপনারা আন্দোলন লড়াইতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম শব্দগুলোকে জাদুঘরে পাঠান। দেখবেন, এদেশের দুর্দিনে দেশপ্রেম কিংবা ১৯৭১’র সন্মুখসারির সেই সাহসী আবেগ কোনোদিনই আর লড়বে না। বরং বিত্তের লড়াইতে চোর-বাটপার, ভুয়া সুশীল আর নব্য ব্যবসায়ী ধনকুবেরা শুকুনের ন্যায় আপনাদের মত নতুন তরুণ প্রজন্মকে ভূখা রেখে তাদের ফাঁয়দা লুটতে আপনাদেরকেই ব্যবহার করছে!

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই এবং লেখক ও গবেষক।

এইচআর/জিকেএস

Read Entire Article