মুন্সি মেহেরুল্লাহ

মুন্সি মেহেরুল্লাহ (রহ.) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামী বক্তা, চিন্তাবিদ, খ্রিষ্টান মিশনারিদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী প্রতিরোধের মুখ, অসামান্য বাগ্মী, যুক্তিনিষ্ঠ পণ্ডিত এবং ধর্মীয় পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার মাগুরা অঞ্চলে এক সাধারণ পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ধর্মশিক্ষা ও আরবি-পার্সি ভাষাজ্ঞান অর্জনের প্রতি তার গভীর আগ্রহ দেখা যায়। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই বালক শিগগিরই কোরআন, হাদিস ও ইসলামের প্রাথমিক শাস্ত্রগুলো দক্ষতা অর্জন করেন। কৈশোরে তিনি কলকাতা ও ফরিদপুরের বিভিন্ন আলেমের কাছে উচ্চতর দাওরায়ে ইসলামিয়ার পাঠ গ্রহণ করেন। আরবি, ফারসি ও বাংলা ভাষায় তার দখল ছিল ঈর্ষণীয়, যা পরবর্তীকালে তাকে একজন শক্তিশালী বক্তা ও লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। মেহেরুল্লাহর মানসগঠনকালে বাংলায় খ্রিষ্টান মিশনারিরা সক্রিয়ভাবে বিতর্ক, প্রচার ও সাহিত্য রচনার মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার প্রয়াস চালাচ্ছিল। সাধারণ মুসলমানদের দুর্বল ধর্মীয় জ্ঞান নিয়ে তারা সহজেই বিভ্রান্ত হতো। এ প্রেক্ষাপটে মেহেরুল্লাহ এগিয়ে আসেন একজন যুক্তিবাদী দাই হিসেবে। মুন্সি মেহেরু

মুন্সি মেহেরুল্লাহ

মুন্সি মেহেরুল্লাহ (রহ.) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামী বক্তা, চিন্তাবিদ, খ্রিষ্টান মিশনারিদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী প্রতিরোধের মুখ, অসামান্য বাগ্মী, যুক্তিনিষ্ঠ পণ্ডিত এবং ধর্মীয় পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার মাগুরা অঞ্চলে এক সাধারণ পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ধর্মশিক্ষা ও আরবি-পার্সি ভাষাজ্ঞান অর্জনের প্রতি তার গভীর আগ্রহ দেখা যায়। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই বালক শিগগিরই কোরআন, হাদিস ও ইসলামের প্রাথমিক শাস্ত্রগুলো দক্ষতা অর্জন করেন।

কৈশোরে তিনি কলকাতা ও ফরিদপুরের বিভিন্ন আলেমের কাছে উচ্চতর দাওরায়ে ইসলামিয়ার পাঠ গ্রহণ করেন। আরবি, ফারসি ও বাংলা ভাষায় তার দখল ছিল ঈর্ষণীয়, যা পরবর্তীকালে তাকে একজন শক্তিশালী বক্তা ও লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। মেহেরুল্লাহর মানসগঠনকালে বাংলায় খ্রিষ্টান মিশনারিরা সক্রিয়ভাবে বিতর্ক, প্রচার ও সাহিত্য রচনার মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার প্রয়াস চালাচ্ছিল। সাধারণ মুসলমানদের দুর্বল ধর্মীয় জ্ঞান নিয়ে তারা সহজেই বিভ্রান্ত হতো। এ প্রেক্ষাপটে মেহেরুল্লাহ এগিয়ে আসেন একজন যুক্তিবাদী দাই হিসেবে।

মুন্সি মেহেরুল্লাহ প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে মিশনারিদের খণ্ডনে যুক্তিতর্ক শুরু করেন। তার বক্তৃতার বৈশিষ্ট্য ছিল স্পষ্ট যুক্তি, ধারালো উপমা, বর্ণনাশক্তি এবং ধর্মগ্রন্থগুলোর গভীর বোঝাপড়া। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এ অঞ্চলের শিক্ষিত সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। বিতর্কে তার সাফল্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল—তিনি কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেন না, বরং প্রতিপক্ষের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে তার ভেতরের অসংগতি উদ্ঘাটন করতেন। এ পদ্ধতির জন্য তিনি মুসলিম সমাজে যেমন সম্মান অর্জন করেন, তেমনি অনেক খ্রিষ্টান মিশনারিও তাকে একজন শক্তিশালী অথচ মর্যাদাবান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতেন।

খ্রিষ্টান মিশনারিদের ভুল ব্যাখ্যা, বিকৃত উদ্ধৃতি ও পক্ষপাতদুষ্ট যুক্তির জবাবে তিনি ধারাবাহিকভাবে পুস্তিকা রচনা করেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ও পুস্তিকাগুলোর মধ্যে ‘খ্রিষ্টান মতের মূলনীতি’, ‘তর্ক-তাহকিক’, ‘ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্ম’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব রচনার মাধ্যমে তিনি শুধু মুসলমানদের ধর্মজ্ঞান শক্তিশালী করেননি, বরং বাংলার ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি যুক্তিবাদী প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

মেহেরুল্লাহর কর্মজীবনের সবচেয়ে আলোচিত অংশ হচ্ছে বিভিন্ন খ্রিষ্টান পাদ্রি ও মিশনারিদের সঙ্গে তার প্রকাশ্য বহু বিতর্ক। ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাগুরা, যশোর ও কলকাতায় অনুষ্ঠিত এসব বিতর্কে হাজারো মানুষ উপস্থিত থাকত। প্রায় প্রতিটি বিতর্কেই তার যুক্তি ও গ্রন্থজ্ঞান প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে দেয় এবং প্রচুর মানুষ ইসলামের প্রতি দৃঢ় হয়। অনেক খ্রিষ্টান ধর্মান্তরিত মুসলমান তার প্রচেষ্টায় পুনরায় ইসলামে প্রত্যাবর্তন করেন, যা সেই সময় সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল।

ধর্মীয় কাজের বাইরে মেহেরুল্লাহ সামাজিক সংস্কারেও ভূমিকা রাখেন। তিনি শিক্ষার প্রসার, নৈতিক উন্নতি ও মুসলমানদের আত্মপরিচয় জাগরণের বিষয়ে বহু বক্তব্য রাখেন। তার জীবন ছিল প্রায় সম্পূর্ণভাবে ইসলামের দাওয়াত, কল্যাণ এবং মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টায় নিবেদিত।

১৯০৭ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মুন্সি মেহেরুল্লাহর মৃত্যু ঘটে। কিন্তু তার জীবনকর্ম আজও বাংলার মুসলিম সমাজে এক অনিবার্য প্রেরণা। তিনি দেখিয়ে গেছেন জ্ঞান, যুক্তি ও চরিত্রের সমন্বয় থাকলে সত্য প্রতিপাদন কখনো দুর্বল হয় না। তার রেখে যাওয়া রচনাবলি ও বিতর্ক-ঐতিহ্য বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে রয়েছে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow