নিজের তাগিদে কেউ দর্শন পড়ে না, বিষয়টি তেমন নয়। তবে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এই বিভাগে ভর্তি হন শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডিগ্রি লাগবে বলে। এতে একদিকে যেমন দর্শন নিয়ে জানতে উৎসুক শিক্ষার্থীর সংখ্যা সন্তোষজনক হয় না, অন্যদিকে আগ্রহ নেই এমন একটি বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষার্থীরাও বিভ্রান্তিতে ভোগেন। দর্শন কেন পড়া প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে পড়ে একজন শিক্ষার্থী কীভাবে ক্যারিয়ার গড়তে পারেন? এ বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া।
জাগো নিউজ: দর্শন পড়া কেন প্রয়োজন?
আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া: প্রথমেই আমি যেটি বলতে চাই তা হলো, শিক্ষা শুধু সার্টিফিকেট বা চাকরির জন্য নয়। শিক্ষা মূলত একজন মানুষের নৈতিক উৎকর্ষ অর্জন করার একটি প্রক্রিয়া। সেই সঙ্গে কিছু কৌশল, মানবিক জ্ঞান অর্জন করা। এই জ্ঞান দ্বারা নিজেকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি সমাজ, রাষ্ট্র ও বৃহত্তর অর্থে পৃথিবীকে সেবা দেওয়া, এটা হলো শিক্ষার বৃহত্তর অর্থ।
সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, দর্শন একজন শিক্ষার্থীকে শেখায় যে নিজস্ব সমাজ, গোষ্ঠী বা পৃথিবীতে আসলে তার প্রয়োজনীয়তা কী, সে সমাজে কী ভূমিকা রাখতে চায়। কালেক্টিভ সমাজকে একটা ইতিবাচক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে কোন ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে চান, এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে সাহায্য করে দর্শন। দর্শনের ইতিহাসে বড় বড় পণ্ডিত ও দার্শনিকরা আমাদের এসবই শিখিয়েছেন। তাই দর্শনের শিক্ষার্থীদের আমি সৌভাগ্যবান বলবো এই অর্থে যে, সেসব পণ্ডিতের চিন্তাগুলো একাডেমিকভাবে জানা-বোঝার সুযোগ তারা পাচ্ছেন, যেটা হয়তো অন্য অনেক বিষয়ে পড়লে জানার সুযোগ পাওয়া যায় না। তাই উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে দর্শনের একটি ডিসিপ্লিন হিসেবে থাকা যথেষ্ট যৌক্তিক বলে আমি মনে করি এবং জ্ঞানের এই শাখার অবদান অনন্য।
আরও পড়ুন:
জাগো নিউজ: চাকরি বা ক্যারিয়ারের বিবেচনায় দর্শনে পড়া কতটা যৌক্তিক?
আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া: আমাদের দেশে গ্র্যাজুয়েশনকে চাকরির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই বিষয়টি একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আবার গুরুত্বহীন। কেননা অনেক সময় দেখা যায় একজন শিক্ষার্থী রসায়ন থেকে পাস করে ব্যাংকে চাকরি করছেন। আবার দর্শন থেকে পাস করে অনেকে দেখা যায় খুব টেকনিক্যাল একটা জায়গায় কাজ করছেন। যেমন আইসিটি বা প্রযুক্তির সঙ্গে খুব সূক্ষ্মভাবে সম্পর্কিত কোনো সেক্টর। কারণ আমাদের এখানে পড়াশোনার সঙ্গে তার স্পেশালাইজেশন ও প্র্যাকটিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন নাই। না থাকার কারণ হিসেবে চাকরির অপ্রতুল্যতা তো আছেই।
দর্শন একটি মল্টিডিসিপ্লিনারি বিষয়, এর নানামুখী শাখা আছে। একজন শিক্ষার্থী যখন দর্শন পড়ে, তাকে বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ইত্যাদির প্রাথমিক পাঠ জানতে হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ওই শিক্ষার্থীর যে বৃহৎ জ্ঞানের ক্ষেত্র ৈতরি হয়, তা দিয়ে সে বহির্বিশ্বের শিক্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে পারে। তাই প্রতিবছর আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছে। আমাদের কলা অনুষদে বিদেশ থেকে উচ্চতর িডগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি দর্শন বিভাগে। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানের। এই কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজ বিভাগ ব্যতীত অন্য বিভাগে গিয়েও বিভিন্ন কোর্স করতে পারছে। একে আমি একটি অপরচুনিটি বলবো। অপরচুনিটি এই অর্থে যে, আমাদের এখানে প্রচুর চাকরির সংকট চলছে, চাকরি নাইই বলা চলে। আর আমাদের নতুন প্রজন্ম কিন্তু দেশের বাইরে চলে যেতে চাচ্ছে। দেশের বাইরে নাগরিত্ব নিয়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা পূরণের ক্ষেত্রে দর্শনে পড়া একটি ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে, কেননা অন্য অনেক সাবজেক্টের তুলনায় দর্শনের শিক্ষার্থীর এই ইচ্ছা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
জাগো নিউজ: দর্শনে পড়ে অন্য ডিসিপ্লিনে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আরেকটু বিস্তারিত বলবেন?
আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া: ফিলোসফি বা দর্শনের কিছু বাইপ্রোডাক্ট আছে। আবার এথিক্স বিভাগে বিভিন্ন ধরনের এথিক্স পড়ানো হচ্ছে। যেমন আমার পরিচিত একজন দর্শন থেকে পড়ে মেডিকেল ফ্যাকাল্টিতে পিএইচডি করছেন। কীভাবে? মেডিকেল ফ্যাকাল্টির একজন শিক্ষক বায়োএথিক্স বা মেডিকেল এথিক্স নিয়ে কাজ করছিলেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এটা সম্ভব হয়েছে। আবার দর্শন থেকে পাস করে কেউ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এথিক্যাল এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করছেন। অর্থাৎ দর্শন একটি মাল্টিডাইমেনশনাল বিষয়। এই বিভাগে পড়ে অনেক ধরনের কাজ করা সম্ভব কিন্তু, শর্ত হলো শিক্ষার্থীকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। তাকে এই সব সম্ভবনা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। তাতে হয়তো এমন কিছুও সে খুঁজে পেতে পারে, যা আগে কেউ করেননি। নিজেকে তৈরি করলে অনেক সম্ভবনা উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানে দর্শনের শিক্ষার্থীরা কী ভূমিকা রাখতে পারে?
আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া: দর্শনের প্রয়োজনীয়তা এতই বেশি যে, আমি মনে করি, এটা শুধু একটি স্বতন্ত্র বিভাগে না, প্রত্যেক বিভাগে প্রত্যেকটা বিষয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দর্শন কোর্স থাকা উচিত। ধরুন একজন প্রযুক্তি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী প্রযুক্তি বিজ্ঞানকে কোথায় নিয়ে যেতে চান, প্রযুক্তির উন্নয়ন কার জন্য করবেন, কেন করবেন, এ প্রযুক্তি মানবকল্যাণে কী কাজে আসবে, এই প্রশ্নগুলো তার সামনে তুলে ধরবে দর্শন। আর এই প্রশ্নগুলো নিয়ে যদি সেই শিক্ষার্থী চিন্তা করতে না শেখেন, তাহলে প্রযুক্তিবিজ্ঞানের ডিগ্রি নিয়ে তার কী লাভ হবে? এখানে যে বিষয়গুলো পড়ানো হয়, তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো মোরাল ফিলোসফি, যাকে আমরা এথিক্স বা নৈতিকতা বলি। প্রযুক্তিবিদ্যার ওই শিক্ষার্থী যদি এথিক্স না জানে তাহলে সে প্রযুক্তিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার তা জানবে না। কোন ধরণের প্রযুক্তি কেন জরুরি, এগুলো নিয়েও সচেতন হবে না। এমন প্রযুক্তিও তো আছে, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। দর্শনের জ্ঞান থাকলে ওই শিক্ষার্থীর নৈতিক মূল্যবোধ তাকে ক্ষতিকর কাজে বাধা দেবে।
আমরা এমন একটা দেশে বসবাস করছি যেখানে দূর্নীতি, দুঃশাসন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এক দূর্নীতিবাজকে সরিয়ে আমরা আরেক দূর্নীতিবাজকে জায়গা করে দিই। এক দুঃশাসনের জায়গায় আরেক দুঃশাসন আসে। এসবই আমার মতে নৈতিকতাচর্চার অভাব ও দর্শনহীনতার কারণে হচ্ছে। তাই আমাদের মতো সমাজে দর্শনের প্রয়োজনীয়তা ডাল-ভাতের প্রয়োজনীয়তার মতো বলে আমি মনে করি। এটা কোনোভাবেই প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ নাই।
আমার কথা যাদের পর্যন্ত পৌঁছাবে, তাদের বলতে চাই যে, মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেন দর্শন পড়তে আসে। তাহলে তারা তাদের মেধা ও দর্শনের অপার সম্ভবনাকে একসঙ্গে করে নিজের জীবন ও পারিপার্শ্বিকতাকে একটি নতুন জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন।
আরও পড়ুন:
এএমপি/আরএমডি/এমএস