অস্ট্রেলিয়ায় ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতিতে চলে রঙের খেলা। পঞ্জিকা অনুযায়ী এখন চলছে শরৎকাল। আমাদের দেশের ভাষায় বললে অবশ্য বলতে হয় হেমন্ত। কারণ জুন মাসের এক তারিখ থেকে শুরু হবে শীতকাল। হেমন্তে বৃক্ষগুলোর পাতা ঝরে যেতে থাকে। তখন সবুজ পাতা হলুদ, খয়েরি, বাদামি, লাল বহুবর্ণ ধারণ করে।
আর এগুলো দেখার জন্য মানুষ অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বাগানে ভিড় করে। গত বছর আমরা এই রঙের খেলা দেখতে মেফিল্ড গার্ডেনে গিয়েছিলাম এবং মনপ্রাণ ভরে সেই সৌন্দর্য দেখেছিলাম। কিন্তু পঁয়ষট্টি হেক্টরের বাগানে আমরা শুধুমাত্র পনের হেক্টর ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ফলে মনের মধ্যে একটা আক্ষেপ কাজ করছিল।
হকিনস ফ্যামিলি যারা এই বাগানের মালিক তারা তখনও পুরো বাগানটা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়নি। বিশেষ বিশেষ সময়ে তারা পুরো বাগনাটা উন্মুক্ত করে দিত। কিন্তু এ বছর থেকে তারা পুরো বাগানটাই দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। মেফিল্ড গার্ডেনের ওয়ায়েবসাইটে এই তথ্য দেখার পর থেকে আমরা আবার যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়েছিলাম বিশেষ করে আমার ছেলেমেয়ে দুজন খুবই উৎসাহ দিচ্ছিল।
সেই সুযোগও এসে গেলো গত রোববার। আগেরদিন রাতে পরোটা আর আলুভাজি করে রাখলাম পরেরদিন বাগানে গিয়ে খাওয়ার জন্য। এটা করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেলো। ঘুমাতে যাওয়ার সময় সকালে ওঠার বিষয়ে একটু সন্দিহান ছিলাম।
পরেরদিন সকালে সবার আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এরপর বাচ্চা দুজনকে ধীরে সুস্থে তুলতে হলো কারণ শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে। ছেলের একই কথা এখনও সকাল হয়নি। অবশেষে ওদের ঘুম থেকে তুলে তৈরি করতে করতে সাড়ে ছ'টা বেজে গেলো।
আমরা তখনই রওনা দিয়ে দিলাম কারণ আমাদের বাসা থেকে মেফিল্ড গার্ডেনে যেতে প্রায় তিনঘণ্টা সময় লাগবে। সিডনি শহর থেকে যেতেও প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। যাত্রাপথে মাত্র একবার থামলাম আমরা মূল রাস্তা থেকে গ্রামের রাস্তায় পড়ার আগে মুহূর্তে। মূল রাস্তা থেকে গ্রামের রাস্তা হয়ে মেফিল্ড গার্ডেনে যেতে সময় লাগে আরো প্রায় এক ঘণ্টা। এই রাস্তার দু পাশের দৃশ্য একেবারে নয়নজুড়ানো, মনমাতানো। আমি কফি আর বাচ্চারা হট চকোলেট আর স্যান্ডউইচ নিয়ে নিলো।
এই রাস্তায় আপনাকে সাবধানে গাড়ি চালাতে হবে। কারণ বেশিরভাগ রাস্তায় গেছে উঁচু উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। তবে মাঝে মধ্যে আপনি রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে নিতে পারেন। উঁচু উঁচু পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে উপত্যকা ছড়িয়ে রয়েছে। আর পাহাড়ের কচ্ছপের পিঠে চড়ে বেড়াচ্ছে দলে দলে গরু অথবা ভেড়া। দূর থেকে এগুলোকে একেবারে ছোট ছোট বিন্দুর মতো দেখায়।
আর রাস্তার পাশে চড়তে থাকা গুরু বা ভেড়াগুলো গাড়ি দেখলে উৎস্যূক দৃষ্টিতে মাথা তুলে তাকায়। কখনও রাস্তার পাশ দিয়ে কুলকুল শব্দ তুলে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। আমরা এইবার অন্য একটা রাস্তা দিয়ে যাওয়াতে একটা ড্যামেরও দেখা পেলাম। সকালবেলা বলে সেখানকার পানিতে মেঘের মতো কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমরা সেখানে কিছুক্ষণ থেমে মেঘের উড়াউড়ি দেখলাম।
মেফিল্ড গার্ডেনে পৌঁছেই আমরা চলে গেলাম ক্যাফের সামনে রাখা কাঠের আগুন পোহাতে। সেখানে কিছুক্ষণ বসে হাত পা সেঁকে নিয়ে টিকিট করে নিলাম। তখনও দিনের ব্যস্ততা সেভাবে শুরু হয়নি তাই লাইন দেওয়া ছাড়াই টিকিট করে ফেললাম। এরপর বাচ্চারা টয়লেট সেরে নিলো। এরপর আমরা মূল বাগানে ঢুকে পড়লাম। আমরা যেহেতু গতবার আগের বাগানটা দেখেছিলাম তাই এবার সোজা পরের বাগানটার দিকে চলে গেলাম।
যেতে যেতে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ হলো। শুভেচ্ছা বিনিময়ের ফাঁকে জানালেন তারা একটা বড় দল ব্রিসবেন থেকে এসেছেন। আমরাও বললাম যে গত বছর এসেছিলাম কিন্তু বাগানের অন্য অংশটা দেখা হয়নি তাই আবার আসা। এরপর আমরা একেবারে বাগানের শেষ প্রান্তে চলে গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর বুঝলাম দুই বাগানের সৌন্দর্য আসলে দুরকম। আগেরটাতে সব পাতাঝরা বৃক্ষ কিন্তু পরেরটাতে প্রায় সবই চিরহরিৎ বৃক্ষ।
সেখানে আমরা শুরুতেই এম্পিথিয়েটারের দেখা পেলাম। অর্ধবৃত্তাকার একটা জায়গাজুড়ে ধাঁপে ধাঁপে সিঁড়ির মতো করে মাটিতে বসার জায়গা করা। আর সামনে খোলা জায়গা যেখানে অনুষ্ঠানগুলো হয়। এরপরই সামনে পড়লো মন্দির এবং ঝর্ণা। ঠিক তার উল্টোদিকে হকিনস পরিবারের বাসভবন। বাগান খুলে দিলেও বাড়ির জায়গাটা দড়ি দিয়ে ঘেরা। বাড়িটাকে দেখলে মনে হবে মেঘের দেশের ঘর। আমরা বাড়ির একটা ছবি তুলে নিলাম।
এরপর একটু এগিয়ে যেতেই দেখা পেলাম সামনে পড়লো ‘ফার্নারি এবং স্টেম্পেরি’। এই জায়গাটা একটু ভীতিকর। ঘন ঝাউবনের মধ্যে মরা গাছের শেকড়বাকর দিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়েছে। তার মধ্যে মৃত জীবজন্তুর সত্যিকারের হাড়ও আছে। এরমধ্যে হাঁটার সময় গা ছমছম করে।
সেখান থেকে বের হতেই সামনে পড়লো পাখিশালায় যাওয়ার রাস্তা। দুপাশে মানুষ সমান উঁচু ঝাউয়ের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে গেলে সামনে পড়বে এটা। সেখানে অনেকদিন পর বাংলাদেশের চড়ুই পাখির দেখা পেলাম। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে বাচ্চাদের খেলার জন্য ‘ফ্লাইং ফক্স’ দোলনা পেলাম। অবশ্য সেটা ততটা ভালো না। আমার ছেলেটা একবার চড়েই আর চড়তে চাইলো না।
আসলে আমরা উন্মুখ হয়েছিলাম গোলকধাঁধার জন্য। এরপর ওখান থেকে বের হতেই সামনে পড়লো 'হারবেসিয়াস বর্ডার'। সেখানে দুপাশে সারিসারি করে গুল্মজাতীয় সব উদ্ভিদের চাষ করা হয়েছে। এরপাশেই রয়েছে 'মেজ'। দূর থেকে মেজের গাছগুলোকে মনেহচ্ছিল হাটু সমান উঁচু কিন্তু সামনে এসে টের পেলাম এগুলোর উচ্চতা মানুষের চেয়ে বেশি।
আমরা প্রবেশপথ দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। আমাদের সাথে আরেকটা পরিবার তাদের বাবা মা ছেলেপুলেসহ প্রবেশ করলো। তবে সবার আগে ছিল উনাদের ছোট বাচ্চাগুলো। কিছু কিছু বাঁকে ছোট ছোট ধাতব সবুজ পাতে 'হিন্টস' দেয়া আছে। সেখানে তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানে হয়েছে এন্ট্রি, এক্সিট এবং মিডল কোন দিকে। আমাদের যাত্রা কেন্দ্রে অর্থাৎ মিডল'র দিকে। আমাদের সবার আগে উনাদের বাচ্চাগুলো সেখানে পৌঁছে গেলো।
এরপর উনাদের সহায়তায় আমরা কেন্দ্রে পৌঁছালাম। কারণ আমরা কেন্দ্রের কাছাকাছি যাওয়ার পর বুঝলাম ঐটা আসলে কানাগলি। কেন্দ্রে আসতে হবে অনেক দূরের রাস্তা দিয়ে। কেন্দ্রে একটা টাওয়ার আছে। তার উপরে একটা ঘন্টা ঝোলানো আছে। আবার সেখানে ওঠার জন্য পাশে একটা সিঁড়ি ছাড়াও কেন্দ্রে একটা সিঁড়ি আছে। বাচ্চারা এখানে খেলায় মেতে উঠলো। আমরা ওখান থেকে নতুন করে যারা আসছিল তাদেরকে পথ বাতলে দিচ্ছিলাম। আমরা দুইবার গোলকধাঁধার এই খেলাটা খেললাম। মনে হচ্ছিল সারাদিন ধরে খেলতে পারলে মন ভরত।
মেজ থেকে বেরিয়েই সামনে পড়লো কাশফুলের মতো একটা ফুলের বাগান। তার সামনেই ছিল পিটার লুন্ডবার্গের ভাস্কর্য, কংক্রিটের একটা বিশালাকার বৃত্ত। এরপর সামনে পড়ল বিশাল হ্রদ। হ্রদের পাড়ে কাঠের পাটাতনের হাঁটা রাস্তা। হ্রদের পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে অগুনতি হাঁস। একটু পরেই হ্রদের পানিতে চাইনিজ প্যাগোডার দ্বীপ চোখে পড়লো। দ্বীপে যাওয়ার জন কাঠের সাঁকো আছে যার রেলিংগুলো টকটকে লাল রঙ করা।
পানিতে সেটার প্রতিফলন একটা চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা করছে। ওখান থেকে বেরিয়ে হ্রদের পাড় ধরে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। একটু পরেই একটা লনের মতো জায়গা চোখে পড়লো। সেটার একেবারে মাথায় একটা বৃত্তকার জায়গা। সেখানে একজন মানুষের পাথর ভাস্কর্য আছে। ঠিক কার ভাস্কর্য সে সম্মন্ধে কোন তথ্য পেলাম না। সেখানে ঘাসের মধ্যে বসে আমরা সাথে আনা পরোটা আর আলুভাজি দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম।
এরপর ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার সময় ক্যাফে থেকে আমরা স্ট্রবেরি পাই এবং ব্যানানা ব্রেড কিনে নিলাম। আপনি চাইলে এখানে বসে দুপুরের খাবার খেতে পারেন তবে এই ক্যাফেটা দুপুর তিনটার পরে আর অর্ডার নেয় না। এরপর আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
সকালে বাচ্চা দুটোকে ঘুম থেকে জাগাতে অনেক কসরৎ করতে হয়েছিল। অনেক আদুরে কথা বলে রাজি করাতে হয়েছিল। বাগান থেকে বেরিয়ে তারা বলল ভোরে ঘুম থেকে ওঠার কষ্ট তাদের সার্থক হয়েছে। শুনে খুবই ভালো লাগলো। আসলে শিশুদেরকে শুধু সৌন্দর্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারলেই হয় এরপর তারা সেটাকে তাদের নিজেদের মতো করে তারা উপভোগ করে।
এমআরএম/এমএস