যতীন স্যার: বানপ্রস্থ ও একটি একান্ত আশ্রয়

4 weeks ago 11

শিশির রাজন

সূর্যের আলোর সব রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে মগড়া নদীর শুভ্র ঘাসে। বাতাসের নরম আদরে দুলছে পাতাদের দল। পাখির কিচিরমিচির প্রভাতের গান গাইছে। মূল রাস্তা পেরিয়ে মিনিট দুই হাঁটলেই আমাদের বাসা। লাঠি হাতে একজন দৃঢ় কণ্ঠে ডেকে চলেছেন—রাজন...বেলা হয়েছে কখন, এখনো উঠোনি। প্রত্যুত্তরে মা বলতেন—অনেক রাতে ঘুমিয়েছে তো তাই উঠেনি। কিন্তু আমার ঘুম ভেঙে যেতো...কোনোভাবে নিজেকে সামলে বিছানা থেকে উঠে পড়তাম। আমি জানতাম কে ডাকছে...কার ডাক পাওয়া আমার আজন্ম সৌভাগ্য। তারপর, তাঁর পিছু পিছু হেঁটে যাওয়া মগড়ার তীর ধরে পালপাড়া মোড়... আরও ভেতর পর্যন্ত যেতে যেতে তিনি বলে যেতেন, বাংলার ইতিহাস, বঙ্কিম, রামমোহন, ভারতবর্ষ, কমিউনিস্ট আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ—আরও যে কত কী!

হ্যাঁ, তিনি অধ্যাপক যতীন সরকার, আমাদের প্রিয় যতীন স্যার। এভাবে কত যে ডেকেছেন, ডেকে নিয়ে আদরে আবদারে নিজের খুব কাজের একজন বানিয়েছেন। ভরিয়ে দিয়েছেন স্নেহ আর ভালোবাসায়।

শত শত দিনের গল্প খুব যত্নে থাকে স্মৃতির গভীর অলিন্দে। সেই ২০০২ সালে কলেজে প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়েছি। স্যার নেত্রকোনায় স্থায়ী হলেন। নেত্রকোনা শহরে আমার পৈত্রিক বাসা আর স্যারের বাসা খুব কাছাকাছি। ঠিক তখন থেকে স্যারের কাছে যাওয়া। ধীরে ধীরে সান্নিধ্যে আসা। আমাদের সকাল সন্ধ্যা আড্ডা ছিল নিয়মিত। দেবজ্যোতি রায় জনি, পল্লব চক্রবর্তী, পরবর্তীতে কবি সজল অনিরুদ্ধ ও মিথুন রায় আরও অনেকে যুক্ত হলো আড্ডায়।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় রুটিন মাফিক আড্ডা হতো স্যারের বাসায় আর স্যার অনর্গল বলে যেতেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বক্তব্য..মানে মাস্টারি...। একদিন স্যারকে প্রশ্ন করলাম—আপনার ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন’-এ কি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ব্যালেন্স করেছেন? উনি আমার কথা শুনে মুচকি হাসলেন। বললেন—যার যেটা প্রাপ্য আমি তা-ই লিখেছি। পরে শুনেছিলাম বন্ধু কবি সজল অনিরুদ্ধও স্যারকে একই প্রশ্ন করেছিল। তাতে নাকি স্যার কিছুটা ক্ষেপেও গিয়েছিলেন।

 বানপ্রস্থ ও একটি একান্ত আশ্রয়

আমাকে নিয়মিত বই পড়তে দিতেন। একটা প্যাডে নাম লিখে বই নিয়ে যেতাম স্যারের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে। ফেরত দেওয়ার পর সেই বই সম্পর্কে জানতে চাইতেন। বইটির যেখানে বুঝিনি তা বুঝিয়ে দিতেন। আমার বাইরে ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতা কম ছিল। অনেকটা ঘরকুনো মানুষ আমি। খুব সন্তর্পণে স্যারের কাছে যেতাম। কোনো রাখঢাখ ছিল না, ছিল না হইচই। স্যার আমাকে ডাকতেন গৃহসন্ন্যাসী বলে।

২০০৭ সালে আমি রক্তে ভেজা গারো পাহাড় (টংক আন্দোলনের ইতিহাস) বইটির কাজ শুরু করলাম। উনি যেখানেই এ সংক্রান্ত কোনো লেখা পেতেন ফোন দিয়ে বলতেন—একটা বই পেয়েছি, আলাদা করে রেখেছি, নিয়ে যেও। ‘রক্তে ভেজা গারো পাহাড়’ বইটির লেখা শেষ করলাম ২০১১ সালে। একদিন স্যারের বাসায় সন্ধ্যা থেকে বসে পুরো লেখাটি পড়ে শোনালাম। স্যার কী যে খুশি হলেন। বইটির ভূমিকা লিখে দিলেন, প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিলেন। আর যাকেই পেতেন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতেন—রাজন দত্ত মজুমদার, টংক আন্দোলন নিয়ে অসাধারণ কাজ করেছে। কত যে প্রসংশা। যা আমার মতো নগন্য মানুষের জন্য ছিল এক পরম প্রাপ্তি।

আমার একটা অভ্যাস ছিল স্যারের সাথে আড্ডার সময় স্যারের কথাগুলো প্রায় প্রতিদিনই ফোনে রেকর্ড করতাম। ২০১৪ সালে তা লিখতে শুরু করলাম। যা নিয়ে ২০১৫ সালে প্রকাশ করলাম ‘যতীন সরকারের জ্ঞানাশ্রম’ বইটি। স্যার পড়লেন। খুব খুশি হলেন। বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণের পর নিজ হতে আবার প্রুফ দেখে দিলেন। বললেন তৃতীয় মুদ্রণে সংশোধণ করে দিও।

যতীন স্যারের বানপ্রস্থ ছিল আমাদের একান্ত আশ্রয়। কতশত ব্যস্ততায় উনি আমাদের সময় দিতেন। কোনো ক্লান্তি ছিল না। ২০১৫ সালের পর নেত্রকোনা ছেড়ে আসি। যখনই যেতাম প্রতিদিন স্যারের সঙ্গে দেখা করতাম। আর ফোনেও কতবার এটা সেটা জানতে চাইতাম, তিনি প্রতিবারই আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিতেন। কখনো বিরক্তিবোধ করছেন বলে মনে হয়নি।

 বানপ্রস্থ ও একটি একান্ত আশ্রয়

১৮ আগস্ট যতীন স্যারের জন্যদিন। কিন্তু এই প্রথম জন্মদিনে স্যার থাকবেন না। এই প্রথম জন্মদিনে স্যারকে ফোনে কিংবা সামনাসামনি শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানানো হবে না। যখনই ভাবি এবার নেত্রকোনায় গিয়ে স্যারকে আর দেখতে পাবো না, তাঁর কথা শুনতে পাবো না, ভেতরটা হু হু করে ওঠে। চারপাশ শূন্য মনে হয়। এবার নেত্রকোনায় গিয়ে ভাস্কর অখিলদাকে হয়তো আর বলবো না—চলেন, স্যারের সাথে দেখা করে আসি।

স্যার ঢাকায় হাসপাতালে থাকার শেষ দিনগুলোতে কতবার গিয়েছি এই আশায় যে, যদি স্যারের সাথে একটু কথা বলতে পারি। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। মহাকালের অসীমে তিনি চলে গেলেন। অধ্যাপক যতীন সরকার আমাদেরই মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর লেখা, বক্তব্য ও সততায়। বেঁচে থাকবেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রেরণা হয়ে। জন্মদিনে অতল শ্রদ্ধা, স্যার।

এমকেআর/জিকেএস

Read Entire Article