যমুনা রেলসেতুতে চলল বাণিজ্যিক ট্রেন

2 hours ago 4

সিরাজগঞ্জ তথা উত্তরাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের যমুনা রেল সেতুর ওপর দিয়ে যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুতে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে দেশের বৃহত্তম এই রেলসেতুটি আগামী মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টা ১৮ মিনিটে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনটি পারাপারের মধ্য দিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ এই রেলসেতু দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। ৫০ কিলোমিটার গতিবেগে ট্রেনটি মাত্র ৬ মিনিটে ১১টা ২৪ মিনিটে সেতু পার হয়। পরে ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামগামী বুড়িমাড়ী এক্সপ্রেস ট্রেন, দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রেস ট্রেনসহ পর্যায়ক্রমে উত্তরাঞ্চলের সব রুটের ট্রেন নতুন এই সেতু দিয়ে যাতায়াত করে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ বীরবল মন্ডল জানান, সিল্কসিটি পারাপারের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ট্রেন যমুনা রেলসেতু পার হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শিডিউল অনুযায়ী বাকি ট্রেনগুলোও স্বাভাবিকভাবে চলাচল করেছে।

রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আজাদুর রহমান জানান, রাজশাহী থেকে ৬০০ যাত্রী নিয়ে সকাল ৪০ মিনিটে ১১ বগির ট্রেনটি ছেড়ে গেছে।  এরপর বিভিন্ন স্টেশন থেকে আরও ৫-৬শ যাত্রী নিয়ে রেলসেতু পার হয়ে ঢাকায় পৌঁছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের (পাকশী) বিভাগীয় ম্যানেজার শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ জানান, সিল্কসিটি ট্রেন যমুনা পার হওয়ার মধ্য দিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত যমুনা রেলসেতু আজকে কমার্সিয়াল কাম ট্রায়াল অপারেশনে যাত্রা শুরু করল। আমরা সকল নিরাপত্তা এনশিওর করে এটি চালিয়েছি। যদিও একশো কিলোমিটার গতিতে চলার কথা। আমরা চালিয়েছি ৫০ কিলোমিটার বেগে। এই ট্রেনটি ৬ মিনিটে ব্রিজ পার হয়েছে। এখন থেকে বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুতে কোন বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল করবে না। ওই সেতু দিয়ে পার হতে ২২ থেকে ২৬ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগতো।

তিনি বলেন, সেতুটি আগামী মার্চের ১৮ তারিখে উদ্বোধন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ উপদেষ্টা মহোদয়ের সময়ের ব্যাপার আছে, তাছাড়াও জাইকার প্রেসিডেন্ট আসবে। দুই লেনের সেতু হলেও প্রথমে একটি লেন দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু করা হয়েছে। সেতুটি পুরোপুরি চালু হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের সাথে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। 

কথা হয়, সিল্কসিটি ট্রেনের যাত্রী সুমাইয়ার সঙ্গে, তিনি বলেন, নতুন রেলসেতু দিয়ে দ্রুতবেগে ট্রেনটি পার হয়েছে। অনেক ভালো লাগছে। আগে যমুনা ব্রিজ দিয়ে আধঘণ্টার মতো সময় লাগতো।

অপর যাত্রী দিপা রানি বলেন, প্রথমবারের মতো রেলসেতু পার হওয়ার অসাধারণ অনুভূতি অনুভব করছি।

আশরাফুল ইসলাম বলেন, আজকে আমি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলাম। আর এ জন্য সকল কাজ ফেলে এসে সয়দাবাদ স্টেশন থেকে সিল্কসিটি ট্রেনে যমুনা রেলসেতু পার হয়েছি।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পরই ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় কমিয়ে দেওয়া হয় ট্রেনের গতিসীমা। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে সেতু পারাপার হওয়ায় সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি ঘটছে শিডিউল বিপর্যয়। বাড়ছে যাত্রী ভোগান্তি। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ৩০০ মিটার উজানে পিলারের পাইলিংয়ের কাজের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয়।

যমুনা রেলসেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে রেলওয়ে সেতু প্রকল্পটির প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। পরে তা ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় উন্নীত হয়ে। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে দেশীয় উৎস থেকে এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা। জাপানি ৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। সেতু নির্মাণে জাপান, ভিয়েতনাম, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের ৭ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করেন। সেতুটিতে ৫০টি পিলার, প্রতি দুই পিলারের মাঝে একটি করে মোট ৪৯টি স্প্যান রয়েছে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৪.৮ কিলোমিটার হলেও দুদিকে ৭ দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট এবং লুপ, সাইডিংসহ মোট ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে।

যমুনা রেলসেতু প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম বলেন, সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এ সেতুর প্রতিটি স্প্যানের ওপর জাপানিদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রেললাইন বসানো হয়েছে। এর ফলে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। 

নির্মিত এই সেতুটি ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগে নতুন দিগন্ত সূচিত করবে। ঢাকার সাথে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের রেল যোগাযোগে বর্তমান যে বিড়ম্বনা রয়েছে সেটা আর থাকবে না। নির্মাণের পর সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ৮৮টি যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করবে। কমে যাবে পরিবহণ খরচও। সেই সাথে মহাসড়কের উপর চাপও অনেকটা কমে আসবে। উত্তরবঙ্গ থেকে বিভিন্ন পণ্য সহজেই ঢাকাসহ সারাদেশ রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।

প্রকল্পের শুরুতে এই সেতুর নাম ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের ডিসেম্বরে সেতুর নাম পাল্টে যমুনা রেল সেতু রাখা হয়।

Read Entire Article