বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েনের আবহে ভারতের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে চীন। ভারতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত শু ফেইহং জানিয়েছেন, দিল্লির ওপর ওয়াশিংটনের চড়া শুল্ক আরোপের কড়া বিরোধিতা করছে বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্রের আচরণকে ‘দাদাগিরির’ আখ্যাও দিয়েছেন তিনি।
কয়েক দিন আগেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ভারত সফরে এসেছিলেন। সে সময় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করা, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, দিল্লি-বেইজিং সম্পর্ককে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর জোর দিয়েছে দুই দেশই।
শিগগির সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিও-র শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে চীনে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ভারত-চীনের সম্পর্কের এই মোড় নিয়ে যেমন আলোচনা হচ্ছে, আবার এই প্রশ্নও উঠেছে যে–– বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ও প্রতিবেশী দুই দেশ, যাদের মধ্যে নানা ইস্যুতে বিবাদ-বৈরিতার ইতিহাসও আছে, তারা কি সত্যিই বন্ধু হয়ে উঠতে পারবে?
স্থিতিশীলতা আসবে?
দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষার বিষয়ে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সাউথ এশিয়ান পলিটিক্স অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের গবেষক উপমন্য বসু বলেছেন, ভারত-চীনের মধ্যে স্থিতিশীলতা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই ইতিবাচক। কিন্তু আসন্ন বৈঠকে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্তসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কী আলোচনা হয়, কে কতটা নেগোশিয়েট করে এবং বিষয়গুলোর আরও রাজনীতিকরণ হবে কি না তার ওপর নির্ভর করছে পুরো ব্যাপারটা।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের পিএইচডি স্কলার গীতাঞ্জলি সিনহা রায়ও ধারণা প্রকাশ করে বলেন, প্রতিবেশী হিসেবে ভারত-চীনের সম্পর্ক ভালো হওয়া উচিত। কিন্তু চীনকে ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং সীমান্তকে সম্মান জানাতে হবে। এই বিষয়গুলো সবসময় ভারতের মাথায় থাকবে। সবার আগে সীমান্তের বিষয়ে সমাধান দরকার। কিন্তু তারপরেও বিবাদিত এলাকা নিয়ে চীন চুপ করে বসে থাকবে বলে মনে হয় না।
দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা ও বিশ্বাস
চীন ভারতের সাম্প্রতিক আলোচনায় দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনায় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য বিষয়, তীর্থযাত্রা, নদী বিষয়ক তথ্য ভাগ করে নেওয়া, সীমান্ত বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে কথা হয়েছে। সার, বিরল মাটি ও টানেল বোরিং মেশিন নিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে চীন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে ২০২৪-২৫ সালে ১২৭.৭ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে উপমন্য বসু বলেছেন, সংঘাতের আবহেও কিন্তু বাণিজ্যের দিক থেকে ভারত বা চীন কেউ কাউকে উপেক্ষা করেনি। সম্প্রতি রেয়ার আর্থ (বিরল খনিজ), মেশিনারি নিয়ে কথা হয়েছে। কাজেই বাণিজ্যের দিক থেকে সম্পর্ক ভালো। কিন্তু ভূ-রাজনীতির কথা মাথায় রাখলে বিশ্বাসের অভাব বিষয়টা সব সময় আছে।
চীনের পক্ষ থেকে সাম্প্রতি বাঁধ ঘোষণা করা বা অরুণাচলের বেশ কয়েকটি জায়গার নাম বদলে ফেলার ঘটনা কিন্তু ভারতের চিন্তার কারণ হয়েই আছে। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি ওয়াং ই-র কাবুল সফরের কথাও টেনে এনেছেন।
তার কথায়, ওয়াং ই কাবুল সফরে গিয়ে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সিপেক (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) তৈরির বিষয়ে আফগানিস্তানের সহযোগিতার কথা ভাবছে চীন। এখান থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তাদের মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি।
ভারত-চীনের সম্পর্কে পাকিস্তানের প্রসঙ্গ টেনেছেন গীতাঞ্জলি সিন রায়ও। তিনি বলেছেন, ১৯৬২ সালের (ভারত-চীন যুদ্ধ) কথা ভারত ভুলতে পারেনি। তারপর ডোকলাম এবং গালওয়ানের মতো ঘটনা ঘটেছে। অনেক সূত্রই দাবি করেছে (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে) অপারেশন সিঁদুরের সময় ভারত চীনের সমর্থন পেয়েছে।
কোয়াড-এর ওপর প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক সমীকরণের আবহে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের জোট কোয়াডে প্রভাব পড়তে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
এ প্রসঙ্গে উপমন্য বসু বলেন, কোয়াডের অস্তিত্ব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের জন্য কোয়াড প্রভাবিত হবে বলে আমার মনে হয় না, কারণ সেখানে জাপানের মতো দেশও রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আচরণের জন্য কূটনৈতিক স্তরে কিছু প্রভাব পড়লেও পলিটিক্যাল রিয়েলিটি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় বলাটা ওভার স্ট্রেচড।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিটিএন